মহালয়ার কথা – Shuvo Mahalaya Pic in Bengali

একটানা একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান বৃষ্টির পর মাঝে মাঝে আকাশে দেখা যায় পেঁজা তুলো র মতো টুকরো টুকরো মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে। কখনো এক পশলাই সমস্ত ভিজিয়ে দিয়ে কখনো বা ঝক ঝক এ রোদ। আকাশে বাতাসে শোনা যায় মা আসছেন। আয়রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে ঢ্যাং কুড় কুড় ঢ্যাং কুড়াকুড় বাদ্যি বেজেছে । সাদা কাশ ফুল দোলা দেয়। শিউলির গন্ধে মোমো করে। একটি বছর পর মা আসছেন। তিনি জগৎ জননী। নারী শক্তির প্রতিনিধি, দুষ্টের দমনকারী মা দূর্গা। সন্তান সন্ততি লক্ষী সরস্বতী গণেশ কার্তিক কে নিয়ে তিনি মর্ত্যে আসেন। সাথে আসে বাহনরা যথা সিংহ, পেঁচা, রাজঁহাস, ইঁদুর, ময়ূর। বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। মূলত চারদিন ধরে এই পুজো চলে।ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী। দশমীতে মায়ের ভাসান।আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষ টি দেবী পক্ষ। ভারত নেপাল বাংলাদেশ প্রভৃতি জায়গায় দুর্গাপূজা মহা সমারোহে পালিত হয়। এমনকি বিদেশেও পালিত হয়। তাছাড়া বেলুড় মঠ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বিভিন্ন শাখায় দুর্গাপুজো হয়।  

1. বর্ষা শেষে শরতের আগমন।

এ সেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে হওয়ার পরে , সকাল বেলায় ঘাসের আগায়ে শিশিরের রেখা ধরে

সকালে শিউলি গাছ টার তলায় সাদা ফুলের চাদরে ভোরে গেছে। চারিদিকে গন্ধে মোমো করছে।ঘাসের ডগায় এক বিন্দু শিশির। সন্ধ্যে বেলা একটু ঠান্ডা হাওয়া আকাশে সাদা রঙের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়ায়।আগমন হয়  ঋতুর রানী শরতের। কবি র ভাষায় বলে উঠি- ‘আজি ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলারে ভাই লুকোচুরির খেলা , নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই’।

2. আকাশে বাতাসে শোনা যায় আগমনীর সুর।

আজ বাজে বোনো মাঝে ওই আগমনীর গান, জগত জননী  মা কে করে আওহ্বান

রৎ মানেই নদীর তীরে কাশ ফুল। শরৎ মানেই গাছে গাছে হাসানুহানা আর ঝিলে শাপলার সমারোহ। খেতে খেতে আমন  ধানের চারা। গাছে গাছে পাকা পাকা তাল। মা দুর্গার আগমনে শরৎ হয় উৎসব মুখর।এই সময় শুধু মাত্র দূর্গা নয় বিশ্বকর্মা গণেশ লক্ষী ও কালী পুজো এই সময়েই হয়।

3. রেডিও য় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বাণী তে মুখরিত আকাশ বাতাস।

পুজোর গন্ধ নিয়ে মহালয়া এলো, মনতোমার আগমনীর বারতা পেলো

দেবীপক্ষের সূচনায় অমাবস্যা দিন টির  নাম মহালয়া। ভোর রাত্রি থেকে আকাশ বাতাস মুখরিত হয় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের বাণী তে। তার মন্ত্র মুগ্ধ কণ্ঠের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় থাকবেন। ১৯৩১ সালে কলকাতার আকাশবাণী বেতারে প্রথম মহালয়া শুরু হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ এর জনপ্রিয়তা এতটাই বেশী ছিল ১৯৭৪ সালে বাংলার সর্বকালের সেরা অভিনেতা উত্তম কুমার কে দিয়ে এই শ্লোক পাঠ করালে আপামর শ্রোতা তা মেনে নিতে পারেনি। তিনি আবার পরে সসম্মানে ফিরে আসেন।

4. বেজে উঠেছে শঙ্খ ধ্বনি। শোনা যাচ্ছে মায়ের পদ ধ্বনি।

বাজলো তোমার্ আলোর বেনু, মাতলোরে ভুবন

দুর্ধষ দৈত্যরাজের আক্রমণে যখন দেবতারা স্বর্গ রাজ্য এর অধিকার হারালেন।তখন দেব গণ ব্রম্হার শরণাপন্ন হন। বিষ্ণু রুদ্রের বদন থেকে তেজোরাশি বিচ্যুত হলো ব্রহ্মহা বিষ্ণুর আনন  থেকে নির্গত হলো তেজ। এই তেজ রশ্মি একত্র হযে সৃষ্টি হলো এক পরমা রূপবতী মূর্তি। তিনি ই জগৎ জননী মা দূর্গা।যিনি সমস্ত শক্তি দিয়ে অসুর নিধন করেছিলেন।

5. মর্ত্যলোকে ভেসে আসে মায়ের আগমনীর গান।

শিশিরে শিশিরে শারদো আকাশে ভোরের আগমনী, শিউলি ঝরানো দিন এসে চিরদিনের বাণী

দেবতা গণ সানন্দে দেখলেন যে দূর্গা মহিষাসুর কে শুলে বিদ্ধ করছেন। তখন অসুরনাশিনী এই দেবী  পৃথিবী তে পরিব্যাপ্ত হন। মর্তলোকে তিনি দশ হাতে সুসজ্জিত মহিষমর্দিনী। হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে শরত  কালে অসুর রা ঘুমিয়ে থাকে। অকালে এই পুজো হয় বলে এটি অকালবোধন নামে পরিচিত।

6. মেয়ে কেমন আছে , সে কবে আসবে বাপের বাড়ি।

আমার আনন্দিনী উমা আজ ও আসেনি তার মায়ের কাছে, হে গিরিরাজ দেখে এস কৈলাসে মা কেমন আছেন

মেয়ে বিয়ে র পর শ্বশুর বাড়ি গেলে সব বাবা মার্ ই একটা চিন্তা থাকে। সে কেমন আছে? বাবার মন কেঁদে ওঠে। উমা অর্থাৎ মা দুর্গা কৈলাসে কেমন আছেন শিবের সাথে তা নিয়ে মা বাবার প্রাণে চিন্তার শেষ নেই। অমন ভাং সেবন কারী, শ্মশান নিবাসী ছাই ভস্ব মাখা জামাই নিয়ে তারা দুজনেই চিন্তিত। তারা উমা এলে প্রশ্ন করেন ‘কও দেখি উমা কেমন ছিলে মা, ভিখারী হরের ঘরে?’

7. পুজোর চারটি দিন বড়ো আনন্দে কাটে।

ষষ্ঠীর ভুবন দিলো আনন্দেতে ভোরে , সপ্তমীতে পুষ্পাঞ্জলি দেব গিয়ে আগে, খুশি মহা অষ্টমীতে সন্ধি পুজো করে, নবমী নিশিরে তোর সইলো না মোর সুখ, দশমীর দিনে মায়ের বিসর্জন হবে

ষষ্ঠীতে মায়ের বোধন হয় ,আমন্ত্রণ ও অধিবাস। সপ্তমীতে নবপ্রত্রিকা প্রবেশ স্থাপন ,অষ্টমীতে বীরাষ্ঠমী ব্রত ,কুমারী পুজো ,সন্ধি পুজো বলিদান। নবমীতে কেবল নবমীর দিনের পুজো হয়। দশমীতে বিসর্জজনের পুজো ,শেষে কুলাচার ,ও  অপরাজিতা পুজো। এই পুজোর সব মন্ত্রই শ্রী শ্রী চন্ডী থেকে পাঠ করা হয়।

8. সারা বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা এই চারটি দিনের জন্য।

মাগো ডাকি তোমায়, সারা বছর ধরে, এসে চলে যাও, তুমি ক্ষনিকের তরে, এত নিঠুর কেন মা,দূর্গা মা আমার মা

এখন মোটামোটি পয়লা  বৈশাখ থেকে শুরু হয়ে যায় পুজোর কাউন ডাউন। পয়লা বৈশাখের হালকা জামা কাপড়ের সাথে কয়েকটা পুজোর জামা কাপড় হয়েই যায়। বাকী থাকে কয়েকটা টুকি টাকি জিনিস।লিপস্টিক নেলপালিশ আর একটু ফেসিয়াল। ব্যাস পুজোর জন্য একেবারে রেডি।

9. মা জগৎ জননী , তিনি বিশ্ব নিয়ন্ত্রক।

ভুবন মোহিনী বন্দি তোমারে, দুর্গে দুর্গতি হারিনি মা

দুর্গার বাহন সিংহ।  শ্রী শ্রী চন্ডীতে সিংহ কে মহা সিংহ বা বাহন কেশরী নামে পরিচিত। বাহন কে বিশেষ করে পুজো করা হয়। লক্ষীর বাহন পেঁচা , যা একান্তই লোক বিশ্বাস থেকে এসেছে।স্বরস্বতী বাহন হংস। হিন্দু দের নিকট এটি একটি পবিত্রতার প্রতীক। কার্তিকের বাহন ময়ূর। সৌন্দর্য ও শৌর্য কার্তিকের এই দুই বৈশিষ্ট তার বাহন ময়ূর এর মধ্যেও বিদ্যমান। গণেশের বাহন ইঁদুর। ইঁদুর মায়া ,অষ্টপাশ ছেদন এর প্রতীক।

10. চার দিন আনন্দে কাটার পর আসে মায়ের বিদায় বেলা।

ঢাকের তালে কোমর দোলে, খুশিতে নাচে মন,আজ বাজা কাসর জমা আসর,থাকবে মা আর কতক্ষন

নবমী র রাত থেকেই মন বিষন্ন হয়ে ওঠে। রাত পেরোলেই দশমী। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় মায়ের বিদায়ের জোগাড়। বাড়ির পুজোর বিসর্জন সকালেই হয়ে যায়। শুরু হয় সিঁদুর খেলা।ছেলেরা করে কোলাকুলি। মিষ্টি মুখ করে শুরু করে  বড়োদের প্রণাম করার পালা।

শেষকথা

শরৎ আসে শিউলি ফুলে

শরৎ আসে কাশে

চিৎকারেতে কান পাতা দায়

উৎপল জলে ভাসে

শরৎ মানেই শিউলি, কাশ, পদ্মের সমারোহ। দুর্গাপুজোয় মেতে ওঠে বাঙালি মন প্রাণ। ঢাক, ঢোল, কাসর ঘন্টায় মুখরিত চারিদিক। পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেল আর মাইকের আওয়াজে আকাশ বাতাস মুখরিত।চারটি দিনের এই আনন্দ। আবার শুরু হয়  পরের বছরের প্ল্যানিং। একটি বছরের অপেক্ষা।

লেখক – শ্রেয়া মৈত্র চ্যাটার্জী 

ছবি – অরিজিৎ দাস