ভূমিকা
কেমন আছেন বন্ধুরা ? আশা করি ভালোই আছেন। আজ আমরা একটু আলোচনা করবো মেছতা নিয়ে। তো চলুন সরাসরি আলোচনার বিষয়ে আশা যাক। আমাদের ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা পাঁচ । ত্বক তার মধ্যে একটি অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। গরম ,ঠান্ডা, ঝড় জল, মশার কামড় সব স্পর্শজনিত অনুভূতির আভাস আমাদের ত্বকই জানান দেয় । আমরা অন্যান্য অঙ্গের থেকে ত্বকের যত্নটা একটু বেশিই নিয়ে থাকি; কারণ কথাতেই আছে “ প্রথমে দর্শনধারী তারপর গুণবিচারী।” মুখের ওপর দাগ পড়লে কারোরই ভালো লাগে না। আর বয়ঃসন্ধিকালে আমরা ত্বক, চুলের যত্ন বেশী করে নিয়ে থাকি। এই সময় যদি মুখে দেখা দেয় মেছতার দাগ তবে তো আর কথাই নেই। রাতের ঘুম উড়িয়ে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়। মেছতা নিয়ে অনেক প্রচলিত ধারণা আমাদের কানে আসে। তাহলে আসুন জেনে নিই মেছতা আসলে ঠিক কি ?
মেছতা জিনিসটা কি ?
আমাদের ত্বকের নীচে মেলানিন নামক এক ধরণের রঞ্জক পদার্থ থাকে। কোন কারণে ত্বকের বিশেষ জায়গায় এটির কার্যক্ষমতা বেশি হলে ত্বকের সেই অংশটি পার্শ্ববতী অংশের চেয়ে বেশি গাঢ় হয়ে যায়। ফলে ওই অংশটি কালো বা বাদামী থেকে হালকা বাদামী দেখায়। একে মেছতা বলে। এটি কোন এলার্জী না বা খারাপ কিছুই করেনা। শুধুমাত্র এইটার একটাই ক্ষতি করে আর তা হলো সৌন্দর্যহানি। আর এটি সাধারণত মুখ মন্ডলের উপরেই হয়ে থাকে।
মেছতা হবার কারণ কি ?
- হরমোন ওষুধ ব্যবহারে বা হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি নিলে।
- ত্বক নিয়মিত ভাল ভাবে পরিষ্কার না করলে।
- প্রোটেকশন ছাড়া অতিরিক্ত সূর্যের আলোতে গেলে এটি হয়। সূর্যের আলোই এটির প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয়।
- জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খেলে।
- হরমোনের তারতম্য ঘটলে, যেমন গর্ভাবস্থায় এটি হয়ে থাকে।
- থাইরয়েড হরমোনের তারতম্য ঘটলে।
- বংশগত কারণে এটা হতে পারে।
মেছতার উপসর্গ
মেছতা শরীরের যে কোন জায়গায় হতে পারে তবে সাধারণত যেসকল জায়গায় সূর্যের আলো বেশি পড়ে সেই জায়গায় বেশি হয়। মেছতার উপসর্গ একটাই ,তা হলো কালো বা বাদামী রঙের ছোপ বিশেষ করে।
- গালে
- নাকের উপরে
- চোখের তলায়
- থুতনিতে
- উপরের ঠোঁটের উপরের অংশে
- গলায়
- ঘাড়ে
- কপালে
- এমনকি হাতেও হতে পারে ।
মেছতার প্রতিকার কি
মেছতা পুরোপুরি প্রতিকার করা সম্ভর হয় না, আবার অনেক সময়ে সেটা সেরেও যায়। আর অবস্থার উন্নতি করা যায়। তাই মেছতা হলে প্রথমেই একজন ভাল ডার্মাটোলজিস্টকে দেখাতে হবে। সাধারণত চিকিত্সকেরা উডস ল্যাম্পের সাহায্যে মেছতা নির্ণয় করে থাকেন। এরপর মেছতার জন্য তারা বিভিন্ন ওষুধের ক্রীম বা জেল দিয়ে থাকেন।
1. Hydroquinone : এটি টাইরোসিনেজ নামক এনজাইমকে বাঁধা দেয়, যা মেলানিন তৈরী করে। ফলে ত্বকের যে জায়গায় মেছতা হয়েছে, সেই জায়গাটি সাদা করতে সাহায্য করে। তাই এটি ডাক্তারদের প্রথম পছন্দ
2. Tretinoin & Corticosteroids : এটি ডাক্তারদের ২য় পছন্দের ওষুধ। মাঝে মাঝে একটি মেডিসিন ৩টি ড্রাগস নিয়ে তৈরী হয়। একে ট্রিপল ক্রীম বলে। এই ট্রিপল ক্রীমে Hydroquinone, Hretinoin & Corticosteroid থাকে।
3. Azelaic Acid or Retinoid : যদিও এটি ব্রণের চিকিত্সায় ব্যবহৃত হয়, তারপরও এটি মাঝে মাঝে মেছতার জন্যও ডাক্তাররা দিয়ে থাকেন। মনে রাখবেন, এগুলো কিন্তু ক্রীম বা জেল হিসেবে মুখে মাখতে হয়। খাওয়ার জন্য নয়। যদি এই ওষুধগুলো দেয়ার পর নিম্নোক্ত উপসর্গগুলো দেখা দেয় তবে ডাক্তারকে দেখাবেন। ত্বকে ইরিটেশন হলে বা চুলকালে, ত্বক কালো হয়ে গেলে ও অন্যান্য সমস্যা হলে।
এছাড়া যে সকল কারণে মেছতা হয়েছে তা পরিহার করা উচিত্। সুগন্ধী কসমেটিক ও পিল ব্যবহার করা ছেড়ে দিতে হবে। সূর্যের আলো থেকে ত্বককে রক্ষা করতে হবে। গর্ভাবস্থায় যে মেছতা হয় তা অনেকসময় বাচ্চা হয়ে যাওয়ার পর আপনাআপনি সেরে যায়। এছাড়াও মেছতার জন্য কিছু টাইপের লেজার ও ক্রায়োসার্জারি ট্রিটমেন্ট-ও আছে।
মেছতার জন্য কোন ফেসিয়াল ভাল ?
বিভিন্ন পার্লারে স্পাতে ফেসিয়ালের ব্যবস্থা থাকে। সেখানে নিয়মিত ফেসিয়াল করলে মেছতার দাগ হালকা হয়।
মেছতার জন্য পিল ফেসিয়াল ও এলোভেরা ফেসিয়াল ভাল।
মেছতার জন্য ঘরোয়া পদ্ধতিতে
- ডিম ও লেবুর রস মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করুন। এরপর ধুয়ে ফেলুন। এভাবে সপ্তাহে ২ বার।
- এলোভেরা, শশা ও মধু একত্রে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে ১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
- লেবুর রস ও সমপরিমাণ জল মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
- এলোভেরা জেল রাতে ঘুমানোর আগে আক্রান্ত স্থানে মেখে সারারাত রেখে পরদিন সকালে হালকা গরম
- জল
- দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এর সাথে ভিটামিন ই ও মেশাতে পারেন। এছাড়া এলোভেরা জেলের তৈরী শরবত খেলেও বেশ উপকার পাবেন।
- আপেল সিডর ভিনেগার ও সমপরিমাণ জল মিশিয়ে আক্রান্ত স্থানে লাগিয়ে ২০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
- পেঁয়াজের রস ও আপেল সিডর ভিনেগার মিশিয়ে লাগিয়ে ১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
- ৫ চামচ হলুদের গুঁড়োর সাথে ১০ চামচ হালকা গরম দুধ মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে ১০ মিনিট পর ধুয়ে ফেলুন।
মেছতা দূর করার ক্রিম
গ্রীক শব্দ মেলাজ থেকে মেলাজমা শব্দের উৎপত্তি যার অর্থ কালো। যে কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারে তবে মহিলারাই বেশি আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে যারা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ওষুধ গ্রহণ করেন বা হরমোন থেরাপি নেন। ত্বকের যে সমস্ত জায়গায় সূর্যরশ্মি বেশি পড়ে সে সমস্ত জায়গা যেমন- উপরের গাল, নাক, ঠোঁট এবং কপালে মেছতা বেশি দেখা যায়।
ত্বক কালো হওয়ার প্রধান উপাদান হল মেলানিন,যা তৈরি হয় ত্বকের একটু নিচে অবস্থিত Melanocyte এ,এবং Transport হয় ত্বকের উপরে অবস্থিত Keratinocyte এর মধ্যে। এতে যত মেলানিন থাকবে ত্বক তত কালো হবে। নির্দিষ্ট জায়গায় মেলানিন বেড়ে যাওয়াই মেছতা তৈরীর কারন। এই মেলানিন উৎপন্ন হয় Tyrosine নামে এক Amino Acid থেকে Tyrosinase enzyme এর সহায়তায়। এখন মনে করতে পারেন, এই amino acid বিহীন প্রোটিন খেলেই তো মেছতা থেকে বাঁচা যায় ! না! এটি একটি Non-Essential Amino Acid, যা না খেলেও আপনার শরীরে তৈরি হবে।তাহলে উপায় ??
Tyrosinase Enzyme টাকেই বন্ধ করতে হবে। হ্যাঁ, এ এনজাইমটাকে বন্ধ করেই মেসতার দাগ দূর করা যায়।
আমাদের শরীরকে যে চামড়া আবৃত করে রাখে, তার বাহিরের অংশকে বলা হয় ইপিডার্মিস এবং এর ইমিডিয়েট নীচের অংশকে বলা হয় ডার্মিস। আমরা বলেছি, মেছতা হচ্ছে স্কীন বা চামড়ার উপরিভাগে মেলানিনের উপস্থিতির ফলে সৃষ্ট এক প্রকার কালো দাগ। আর মেলানিন তৈরী হয় মেলানোসাইট নামক এক প্রকার কোষের মধ্যে। মেলানোসাইট হচ্ছে চামড়ার মধ্যাকার এক প্রকার কোষ।
মেলানোসাইটে মেলানিন তৈরীর প্রকৃয়া তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়।
1. এক্টিভেশান অফ মেলানোসাইট
2. সিনথেসিস অফ মেলানিন
3. এক্সপ্রেশান অফ মেলানিন অন দ্যা সারফেস অফ দ্যা স্কিন।
এক্টিভেশান অফ মেলানোসাইট
এতে কিছু ফ্যাক্টর জড়িত, যা মেলেনোসাইটকে এক্টিভেট করে। মেলানোসাইট এক্টিভেট না হলে তা হতে মেলানিন তৈরী হবেনা। আর মেলানোসাইটকে এক্টিভেট করে কিছু জিনিস, যেমন- সূর্যের আলো, প্রচন্ড মানসিক চাপ, ইরিটেশান, জন্ম নিয়ন্ত্রন বড়ি ও হরমোন থেরাপী। এগুলোই মূলত মেলানোসাইটকে এক্টিভেট করে এবং মেলানিন তৈরী করে। মেলানোসাইট এক্টিভেট হবার পর, এখান থেকে বিভিন্ন প্রকৃয়ার মাধ্যমে মেলানিন সিনথেসিস হয়। আমরা বলেছি, মেলানোসাইট চামড়ার একটু নীচে অবস্থিত থাকে। এখানে মেলানিন তৈরী হবার পর উক্ত মেলানিন চামড়ার উপরে অবস্থিত কেরাটিনোসাইট নামক কোষে পৌঁছে। এখানে যতো মেলানিন থাকবে, ত্বক ততবেশি কালো হবে এবং এর চিকিৎসাও তত জটিল হবে। মুখের দাগ দূর করার জন্য হরেক রকমের কসমেটিক্স ব্যবহার করা হয়; যার অনেক উপাদানই ক্ষতিকর। মিডিয়ার কল্যানে আমারাও এ বিষয়ে অবগত। সুতরাং মেছতার দাগ দূর করার জন্য আমরা এর মেডিক্যাল ট্রিটমেন্ট সম্পর্কে আলোচনার চেষ্টা করবো।
তবে মেসতার চিকিৎসার জন্য সর্বপ্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হচ্ছে সূর্যের আলো থেকে দূরে থাকা। অর্থাৎ, সূর্যের আলোকে সরাসরি শরীরে পড়া থেকে প্রটেক্ট করা। সেজন্য ক্যাপ, বিভিন্ন ধরনের পোষাক, (কোন গ্রহনযোগ্য অথোরিটি কতৃক অনুমোদিত) সানস্ক্রীম বা লোশন ব্যবহার করা যেতে পারে। এটিই প্রাথমিক চিকিৎসা। তবে পূর্ন চিকিৎসা নয়। আমেরিকান একাডেমী অফ ডার্মাটোলজির মতে, শুধুমাত্র সানস্ক্রীম যথেষ্ট নয়।
Tyrosinase Enzyme টাকে বন্ধ করলেই মেছতা দাগ দূর করা সম্ভব হবে। আর হাইড্রোকুইনোন এ কাজটিই করে।
ট্রিটিনয়িন এটি এক প্রকার ভিটামিন। এটি স্কীনকে সুন্দর করে, মোলায়েম করে, আকর্ষনীয় করে তোলে।
ফ্লুসিনোলন এসিটোনাইড এটি এক প্রকার মাইল্ড কর্টিকস্টেরয়েড। মাইল্ড কর্টিকসটেরয়েড হবার কারনে এটিকে স্কীনে ব্যবহার করা যায়। এটি স্কীনে কোন প্রদাহ বা ইনফ্লেমেশান থাকলে অথবা কোন চুলকানী থাকলে তা দূর করে।
শেষ কথা
সুস্থ জীবন কাটান , নিয়মিত ও পরিমিত খাবার খান। ত্বকের যত্ন নিন। মেছতাকে চিনে নিন, তার প্রতিকারে,প্রতিরোধে নিয়ে নিন জরুরী কিছু ব্যবস্থা ।আর মেছতার দাগ নিয়ে চিন্তিত হবেন না । আপনার জন্য তো রইলই মেছতা দূর করার এই কয়েকটি বিশেষ ওষুধ। তবে একটা কথা বলবো যে শুধু মেছতা কোনো কোনো কিছুই বেশি বাড়াবাড়ি হলে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত বা ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। জন সাধারণের জন্য পোস্টটি শেয়ার করুন।
লেখক – শান্তনু পাল