swami Vivekananda – স্বামী বিবেকানন্দ

মানুষের জীবন থাকলে তাতে নানা রকম ওঠা পড়াও থাকে, কথায় বলে যতক্ষন তোমার জীবনে ওঠা পড়া আছে ততক্ষন তোমার জীবন আছে।যেদিন জীবন থেকে সমস্ত ভাবনা-চিন্তা চলে যাবে সেদিন আর জীবনও থাকবেনা। সেই জীবনে এগোতে আমাদের নানা রকম সুবিধে-অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু সেই সমস্ত বাধা বিপত্তি পেরিয়েই আমাদের আবার জীবনের পথে এগিয়ে চলতে হয়। সেই চলার পথের আলোক দিশাই দিয়ে গেছেন বেশ কিছু প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তি, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন স্বামী বিবেকানন্দ, এই বেদান্ত সাধক আমাদের এক নতুন ভারত, এক নতুন সময়ের আলো দেন বারে বারে, তিনি বার বার আমাদের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, আরো উন্নতি করার জন্য অনুপ্রেরণা দেয়। তাঁর কথাতেই সারা বিশ্ব জানতে পারে যে এই পোড়ার দেশেও জানার মত দেখার মত কিছু আছে, শিক্ষা আছে, ভাবনা আছে আর আছে দর্শন যা সমস্ত পৃথিবীর কথা বলে। তার কিছু কথা আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে জীবনে এগিয়ে চলার জন্য, ভালো করার জন্য আরো আরো ভালো করার জন্য। এমন কিছু উক্তি (motivational speech in bangla), এমন কিছু ভাষ্য আছে যা আমাদের জীবনের চলার পথকে মসৃন করে তোলে।

স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতার এক উচ্চবিত্ত হিন্দু বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার প্রতি তিনি আকর্ষিত হতেন। তার গুরু রামকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে তিনি শেখেন, সকল জীবই ঈশ্বরের প্রতিভূ; তাই মানুষের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিবেকানন্দ ভারতীয় উপমহাদেশ ভালোভাবে ঘুরে দেখেন এবং ব্রিটিশ ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দের বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় ভারত ও হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও ইউরোপে তিনি হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অসংখ্য সাধারণ ও ঘরোয়া বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ক্লাস নিয়েছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিকাগো বক্তৃতাকর্মযোগরাজযোগজ্ঞানযোগহার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্তভারতে বিবেকানন্দভাববার কথাপরিব্রাজকপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্যবর্তমান ভারতবীরবাণী (কবিতা-সংকলন), মদীয় আচার্যদেব ইত্যাদি। বিবেকানন্দ ছিলেন সংগীতজ্ঞ ও গায়ক। তাঁর রচিত দুটি বিখ্যাত গান হল “খণ্ডন-ভব-বন্ধন” (শ্রীরামকৃষ্ণ আরাত্রিক ভজন) ও “নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি”। এছাড়া “নাচুক তাহাতে শ্যামা”, “৪ জুলাইয়ের প্রতি”, “সন্ন্যাসীর গীতি” ও “সখার প্রতি” তার রচিত কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা। “সখার প্রতি” কবিতার অন্তিম দুইটি চরণ– “বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? / জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” – বিবেকানন্দের সর্বাধিক উদ্ধৃত একটি উক্তি।

স্বামী বিবেকানন্দ শুধু বাঙালির জীবনের এক আদর্শ মহামানবই নন, তিনি যুগাবতার। তাঁর দেখানো আদর্শের রাস্তা যুক্তিবোধের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় মানুষকে। আধ্যত্মকে এক অন্য পর্যায়ে উন্নতি করে স্বামীজী সকলের জীবনকে আরও বেশি করে আলোর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। নেতিবাচক ভাবনার অন্ধকার দিকটির পর্দা সরিয়ে তিনি বাঙালির জীবনবোধকে আরও বেশি করে অনুপ্রাণিত করেছেন। উদ্বুদ্ধ হয়েছে যুব সমাজ, আর সেজন্যই তার জন্মদিন ১২ জানুয়ারি যুব দিবস বলে খ্যাত। দেখে নেওয়া যাক, স্বামীজির কিছু অমর বাণী।

১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের দিন উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন নরেন্দ্র নাথ দত্ত। ছোট থেকেই মেধাবী নরেন্দ্র নাথ স্কটিশ চার্চ কেলেজে পড়াকালীন যুক্তিবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে যুক্তিবোধ আর আধাত্ম ফুটে ওঠে তাঁর বাণীতে। শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের শিষ্য নরেন ,১৮৮৬ সালে সন্ন্যাস গ্রহণ করে হয়ে ওঠেন স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজি সমগ্র আমেরিকা এবং ইউরোপে বেদান্তর দর্শন শিক্ষা (philosophy) প্রচার করেছিলেন | শিকাগোতে দেওয়া তাঁর সেই অমূল্য ভাষণ আজ সারা জগৎ বিখ্যাত, এর মাধ্যমে স্বামীজি সারা দুনিয়ায় হিন্দুত্ব তথা ভারতের নাম উজ্জ্বল করেন |শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রিয় শিষ্য ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ এবং তাঁর গুরুর নামে তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের স্থাপন করেন যা বর্তমানে হাওড়া জেলার বেলুড়ে অবস্থিত |

স্বামী বিবেকানন্দের কিছু বাণী- 

“কখনও বড় পরিকল্পনার হিসাব করবেন না, ধীরে ধীরে আগে শুরু করুন, আপনার ভূমি নির্মাণ করুন তারপর ধীরে ধীরে এটিকে  প্রসার করুন” – Swami Vivekananda

“কখনো না বলোনা, কখনো বলোনা আমি করতে পারবোনা | তুমি অনন্ত এবং সব শক্তি তোমার ভিতরে আছে, তুমি সব কিছুই করতে পারো”  – Swami Vivekananda

“যা কিছু আপনাকে শারীরিক, বৌদ্ধিক এবং আধ্যাত্মিকভাবে দুর্বল করে তোলে সেটাকে বিষ ভেবে প্রত্যাখ্যান করুন” – Swami Vivekananda

“দুনিয়া আপনার সম্বন্ধে কি ভাবছে সেটা তাদের ভাবতে দিন | আপনি আপনার লক্ষ্যগুলিতে দৃঢ় থাকুন, দুনিয়া আপনার একদিন পায়ের সম্মুখে হবে” – Swami Vivekananda

“যখন আপনি ব্যস্ত থাকেন তখন সব কিছুই সহজ বলে মনে হয় কিন্তু অলস হলে কোনো কিছুই সহজ বলে মনে হয়না” – Swami Vivekananda

“ইচ্ছা, অজ্ঞতা এবং বৈষম্য – এই তিনটিই হলো বন্ধনের ত্রিমূর্তি” – Swami Vivekananda

“মানুষের সেবাই হলো ভগবানের সেবা” – Swami Vivekananda

“মহাবিশ্বের সীমাহীন পুস্তকালয় আপনার মনের ভীতর অবস্থিত” – Swami Vivekananda

“ওঠো এবং ততক্ষণ অবধি থেমো না, যতক্ষণ না তুমি সফল হচ্ছ” – Swami Vivekananda

“যতক্ষণ না আপনি নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখবেন, ততক্ষন আপনি ঈশ্বরকে বিশ্বাস করবেন না” – Swami Vivekananda

 “মনের শক্তি সূর্যের কিরণের মত, যখন এটি এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হয় তখনই এটি চকচক করে ওঠে” – Swami Vivekananda

“নিজের জীবনে ঝুঁকি নিন, যদি আপনি জেতেন তাহলে নেতৃত্ব করবেন আর যদি হারেন তাহলে আপনি অন্যদের সঠিক পথ দেখাতে পারবেন” – Swami Vivekananda

“ আদান-প্রদানই প্রকৃতির নিয়ম; ভারতের যদি আবার উঠিতে হয়, তবে তাহাকে নিজ ঐশ্বর্য-ভান্ডার উন্মুক্ত করিয়া পৃথিবীর সমুদয় জাতির ভিতর ছড়াইয়া দিতে হইবে এবং পরিবর্তে অপরে যাহা কিছু দেয়, তাহাই গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। ”– Swami Vivekananda

“ অন্ন! অন্ন! যে ভগবান এখানে আমাকে অন্ন দিতে পারেন না তিনি যে আমাকে স্বর্গে অনন্ত স্বুখে রাখিবেন – ইহা আমি বিশ্বাস করি না।” – Swami Vivekananda

“ যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেশের একটি কুকুরও ক্ষুধার্ত, আমার সমগ্র ধর্মকে একে খাওয়াতে হবে এবং এর সেবা করতে হবে, তা না করে অন্য যাই করা হোক না কেন তার সবই অধার্মিক ”– Swami Vivekananda

মানুষের কল্যাণ এবং সার্বিক উন্নতিতে কাজ করার অভীপ্সায় স্বামী বিবেকানন্দ হাজার বার জন্মগ্রহণে রাজি। এর জন্য নরকে যেতেও তিনি প্রস্তুত। শত শত বুদ্ধের কারুণ্য-নিষিক্ত হৃদয়বান মানুষই ছিল তাঁর কাঙ্ক্ষিত। অজ্ঞ, কাতর, পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর কাজে, তাদের স্বমহিমায় উদ্ভাসিত করার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তাই তাঁর ধর্ম-দর্শন-অধ্যাত্মচিন্তার সবটাই জুড়ে আছে মানুষের কথা। তাঁর কাজ, চিঠি, প্রবন্ধ, বক্তৃতা নিজের হাতে গড়ে তোলা রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের কেন্দ্রেও সেই মানুষের কল্যাণ ও উত্থানের প্রসঙ্গ এবং প্রাধান্য। গুরুভাই তূরীয়ানন্দকে তিনি বলেন, ‘জীবে জীবে, বিশেষত মানুষের মধ্যে তাঁর অবস্থান’। ‘তাঁর’ অর্থাৎ মানুষ যাঁকে বলে দেবতা। যোগীর ধারণায় পরমপুরুষ—ভগবান—ঈশ্বর! বৈদান্তিক অনুভবে তিনিই পরমব্রহ্ম। শ্রীরামকৃষ্ণের কথায় ‘পাকা আমি’।

বিবেকানন্দ বুঝেছিলেন যে, দেবতা আকাশ থেকে নামেন না বা মাটি ফুঁড়েও ওঠেন না। বিবেকানন্দ চান জীবন্ত মানুষের পুজো। শিষ্যবর্গ এবং সতীর্থদের প্রতি তাঁর নির্দেশ, ‘মানুষের জন্য কাজ (যা পুজোরই শামিল) করে করে তোরা শেষ হয়ে যা, এটাই আমার আশীর্বাদ।’ বিষয়টি শ্রীরামকৃষ্ণ নির্দেশিত ‘শিবজ্ঞানে জীবসেবা’রই নামান্তর।