শাস্ত্রমতে‚ মহাশিবরাত্রি ব্রত কথা – Shiv Katha in Bengali
ভারতবর্ষে প্রচলিত দেবদেবীগণের মধ্যে সর্বাধিক পূজিত হলেন শিব‚ শঙ্কর বা মহাদেব।
‘ব্রত’ হল ভালবেসে কাউকে কাছে পাওয়ার সাধনা। তাই শিবসান্নিধ্য লাভের সাধনাই হল শিবরাত্রির ব্রত। ভারতীয় সংস্কৃতিতে ‘সত্য শিব সুন্দর’ — এই তিনটি শব্দের মধ্যেই শিব শব্দের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখা যায়। শিব ও সত্য পরস্পর এক ও অভিন্ন। তাই শিবরাত্রিতে সত্য জীবন যাপনের জন্য নতুন করে সংকল্প করতে হয়। ঐ সত্যনিষ্ঠা মন‚ বাক্য ও আচরণে সর্বদা যত্ন সহকারে পালন করা হলেই পরম সুন্দর শিব-চেতনায় মনটা ভরে ওঠে। বিবেকানন্দ বলেছেন‚ ‘ সত্যের জন্য সব কিছু ত্যাগ করা যায়। কিন্তু কোনও কিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না। কারণ সত্যকে আশ্রয় করে থাকলেই মানবিক গুণগুলি মনকে অবলম্বন করে থাকে। অন্যথায় দয়া‚ মায়া‚ মমতা‚ ধৈর্য‚ সহিষ্ণুতা‚ ভালবাসা‚ ক্ষমা করার ইচ্ছা ইত্যাদি গুণগুলি ক্রমে ক্রমে সরে যায়।
শ্রীমা সারদামণি স্বয়ং বলেছেন – ‘যে সত্যে আছে সে ভগবানের কোলে শুয়ে আছে।
এ বারে দেখা যাক মহাদেব কীভাবে শিব বা শঙ্কর হলেন ?
‘শিব’ শব্দের অর্থ হল মঙ্গলময় বা কল্যাণকর । যিনি সকল জীবের ‘শং’ সম্পাদন করেন বা সর্বদা মঙ্গল করেন তিনিই তো শঙ্কর। সংসারের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার মধ্যে চির মঙ্গলময় বা আনন্দময় কাউকে খোঁজাই তো শঙ্করকে খোঁজা । শিবের মাথায় জল ঢালে কেন
সংসারে যা চিৎ বা চৈতন্যস্বরূপ‚ তাই মঙ্গলময়। সুখের আকর। ‘সুন্দর’ হল অনন্তের অভিব্যক্তি । অনন্ত সুন্দরের প্রকাশ হলেন শিব । শিব এই সুন্দরের বিকাশ ঘটিয়েছেন তপস্যার মাধ্যমে । শিবের অনুপম নৃত্য থেকেই ভারতীয় নাট্যধারার প্রবর্তন আর ডমরুর বাদ্যধ্বনি থেকেই সৃষ্টি রাগ-রাগিনীর । তাই শিব হলেন ভারতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যের জনক ।
এই শিবসান্নিধ্য লাভের চেষ্টা বা সাধনা করলে কী ফল হয় তা ছোট্ট একটি ঘটনায় জানা যায় । বহুকাল আগে অর্বুদ নামে ফলফুল‚ গাছ গাছালি ও পশুপাখিতে ভরা একটা স্থান ছিল । সেখানে সুন্দর সেন নামে এক ব্যাধ বাস করত । পশু-পাখি শিকার করেই তার সংসার চলত। আর এভাবেই সে হয়ে উঠেছিল খুব নিষ্ঠুর । সে একদিন শিকারে বেরিয়ে কিছুই পেল না ।
এদিকে শিকারের আশায় বেশি ঘোরাঘুরি করার ফলে সে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল। সন্ধ্যা আগত দেখে সে এক সরোবরের নিকট একটা গাছের তলায় আশ্রয় নিল । জায়গাটিতে ঘাস না থাকায় ধুলোময়লা থাকায় ব্যাধ মাথায় বাঁধা কাপড়টি সরোবরের জলে ভিজিয়ে নিয়ে গাছতলায় ছিটিয়ে পরিষ্কার করে নিল । ইতিমধ্যে দু চারটি পাতাও গাছ থেকে পড়ল । আর ব্যাধ সেখানে শুয়ে পড়ল ।
শিব রাত্রির ইতিহাস
ব্যাধ জানত না গাছটি বেলগাছ এবং তার তলায় রয়েছে শিবলিঙ্গ । তাই ব্যাধ যখন জল নিয়ে এসে ছিটিয়েছিল‚ সেই জলে শিবলিঙ্গের স্নান হয় আর ওপর থেকে বেলপাতা পড়ায় তা দিয়ে অর্চনার কাজ সম্পন্ন হয়। এদিকে ব্যাধ সেখানে শুয়ে পড়লে তার মাথা শিবলিঙ্গ স্পর্শ করে । সেদিন ছিল শিবরাত্রি । ফলে মহানন্দে শিব তার শরীর থেকে প্রাণীহত্যার সমস্ত পাপ মুক্ত করে দিলেন । পরদিন সকালে ব্যাধ বাড়ি ফিরে গেল । ক্রমে একদিন ব্যাধের অন্তিম সময় উপস্থিত হল । তাকে নিয়ে যেতে উপস্থিত হল দুই যমদূত। কিন্তু সে সময় শিবদূতরা এসে যমদূতের কাছ থেকে তাকে ছিনিয়ে নিয়ে শিবলোকে চলে গেল । এ থেকে জানা যায় নিজের অজান্তে জল‚ বেলপাতা আর স্পর্শ দিয়ে ব্যাধ যদি শিবলোকে যেতে পারে‚ তাহলে সজ্ঞানে মানুষ এই ভক্তি দেখালে কত কী যে পেতে পারেন তা বলাই বাহুল্য । শাস্ত্রমতে বারো বছর এই ব্রত পালন করলে ব্রতী ইহজীবনে কীর্তি‚ সম্পদ লাভ করে দেহান্তে শিবলোকে যাত্রা করে ।
শীতের শেষে মাঘ বা ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে শিব পার্বতীর বিবাহ । এদিনই মহাদেব স্বয়ম্ভূ হয়েও লিঙ্গরূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন । এদিন তাই প্রায় সমস্ত শিবমন্দিরে লিঙ্গোদ্ভব পুজো করা হয় ।প্রিয় পত্নী পার্বতীর প্রশ্নের উত্তরে শিব বলেন — ‘এদিন যারা সারা দিন উপবাস করে রাত জেগে আমার পুজো করবে‚ মাথায় বেলপাতা ও গঙ্গাজল ঢালবে‚ তারা যত পাপই করুন না কেন‚—-আমি তাদের পাপের বোঝা মুক্ত করে সত্যস্বরূপে প্রতিষ্ঠা করব ।
পুরাণমতে শিবরাত্রির আগের দিন অর্থাৎ ত্রয়োদশী তিথিতে সংযমী থেকে চতুর্দশীতে উপবাস করে পঞ্চাক্ষর মন্ত্র ‘ নমঃ শিবায়’ উচ্চারণে ভক্তরা ভক্তি নিবেদন করে । পরে রাতে শিবলিঙ্গকে প্রথম প্রহরে ‘ হ্রীং ঈষণায় নমঃ’ মন্ত্রে দুধ দিয়ে‚ দ্বিতীয় প্রহরে ‘ হ্রীং অঘোরায় নমঃ’ মন্ত্রে দই দিয়ে‚ তৃতীয় প্রহরে ‘ হ্রীং বামদেবায় নমঃ’ মন্ত্রে ঘি দিয়ে এবং চতুর্থ প্রহরে ‘ হ্রীং সদ্যোজাতায় নমঃ’ মন্ত্রে মধু দিয়ে স্নান করিয়ে পুজো করতে হয় । এই সময় প্রার্থনা করা হয়‚ হে শিব‚ তোমাকে নমস্কার । তুমি সৌভাগ্য‚ আরোগ্য‚ বিদ্যা‚ অর্থ‚ স্বর্গ‚ অপবর্গ দিয়ে থাকো । তাই এগুলো তোমার কাছে প্রার্থনা করছি । হে গৌরীপতি‚ তুমি আমাদের ধর্ম‚ জ্ঞান‚ সৌভাগ্য‚ কাম‚ সন্তান‚ আয়ু ও অপবর্গ দাও। চতুর্দশীর পরদিন ব্রাহ্মণের নিকট ব্রতকথা শুনে তাঁকে পুজো করে ভোজন ও যথাসাধ্য দক্ষিণা দানের বিধান আছে। নচেৎ শিব-রাত্রি ব্রত সম্পূর্ণ হয় না । পুরাণে উক্ত আছে—-যজ্ঞ‚ তীর্থ ‚ দর্শন‚ দান কিংবা অন্য কোনও ব্রতই মহাশিবরাত্রি ব্রতের এক ক্ষুদ্র অংশের সমান ফলদায়ক নয় ।
শিবরাত্রি প্রসঙ্গে লিখতে বসে এ কথা না লিখে পারা যাচ্ছে না তা হল‚ সাধারণ মানুষের মধ্যে সত্যনিষ্ঠা ক্রমশ কমে যাচ্ছে । জীবনের মূল্যবোধও লুপ্তপ্রায় ।সারা বছর নানারকম উৎসব চলে । কিন্তু উৎসবের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কর্মকর্তারা অজ্ঞান । ফলে ভোগসর্বস্ব শৃঙ্খলাহীন‚ নিয়মানুবর্তিতাহীন‚ সত্যহীন আচরণেই তারা মেতে উঠেছে । তাইভক্তি ভরে শিবরাত্রি পালন করা প্রয়োজন । শিবের কৃপা লাভ করলেই সমাজে শান্তি ফিরে আসবে ।