লক্ষী পূজার নিয়ম, কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার ব্রতকথা

লক্ষী পুজো কখন হয় 

নিয়ম করে প্রত্যেক গুরু বার অর্থাৎ প্রত্যেক বৃহস্পতি বার আমাদে র সবার বাড়িতেই এই পুজো হয়ে থাকে। রীতিমতো সব নিয়ম ও নিষ্ঠা মেনেই এই পুজো করা হয়। সাধারণত দুপুর বেলায় এই পুজো করা হয়ে থাকে। কিন্তু অনেকেই এই নিত্য ঘরোয়া গুরু বারের পুজো তাদের সময় অনুযায়ী করে থাকে, তবে এই পুজো সাধারণত সাশ্র মতে গোধূলি অর্থাৎ সন্ধে বেলায় করলে ভালো হয়। তার কারণ পৌরাণিক মতানুযায়ী সোধে বেলায় মা লক্ষী সবার ঘরে ঘরে পদার্পর্ন করে থাকে। তবে বছরে একবার আমাদের উৎসবের মতো লক্ষী পুজো হয়ে থাকে বা আমরা করে থাকি সেটা হল দূর্গা পুজোর ঠিক চার দিন পর। সেই পুজো আরও অংকে জাগ জমগ করে হয়ে থাকে। সেটাও আমাদের এক অন্যতম উৎসব।

লক্ষী পুজো কোথায় হয় 

গুরুবারের বা বৃহস্পতি বারের লক্ষী পুজো আমাদের সকলের বাড়িতে বাড়িতে বৃহস্পতি বার হয়ে থাকে। এই পুজোয় মা লক্ষীর মঙ্গোল ঘট বসে।

কেন লক্ষী পুজো হয়  

আমরা গুরু বার মানে বৃহস্পতি বার এ আমরা ঘরে ঘরে লক্ষী পুজো করে থাকি।  জ্যোতিষসাশ্র মতে বলা হয় যে মানুষের ভাগ্যে বৃহস্পতির অবস্থান সঠিকভাবে থাকে সে কোনোদিন অর্থ কষ্টে পীড়িত হয়না।

লক্ষী পুজোর পৌরাণিক গল্প

বাঙালি হিন্দুরা প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীর সাপ্তাহিক পূজা করে থাকেন। এই পূজা সাধারণত বাড়ির সধবা স্ত্রীলোকেরাই করে থাকেন। “বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা”-য় এই বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীব্রত ও পূজা প্রচলন সম্পর্কে একটি যে লৌকিক গল্পটি রয়েছে, তা এইরকম: এক দোলপূর্ণিমার রাতে নারদ বৈকুণ্ঠেলক্ষ্মী ও নারায়ণের কাছে গিয়ে মর্ত্যের অধিবাসীদের নানা দুঃখকষ্টের কথা বললেন। লক্ষ্মী মানুষের নিজেদের কুকর্মের ফলকেই এই সব দুঃখের কারণ বলে চিহ্নিত করলেন।. কিন্তু নারদের অনুরোধে মানুষের দুঃখকষ্ট ঘোচাতে তিনি মর্ত্যলোকে লক্ষ্মীব্রত প্রচার করতে এলেন। অবন্তী নগরে ধনেশ্বর নামে এক ধনী বণিক বাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর ছেলেদের মধ্যে বিষয়সম্পত্তি ও অন্যান্য ব্যাপার নিয়ে ঝগড়া চলছিল। ধনেশ্বরের বিধবা পত্নী সেই ঝগড়ায় অতিষ্ঠ হয়ে বনে আত্মহত্যা করতে এসেছিলেন। লক্ষ্মী তাঁকে লক্ষ্মীব্রত করার উপদেশ দিয়ে ফেরত পাঠালেন। ধনেশ্বরের স্ত্রী নিজের পুত্রবধূদের দিয়ে লক্ষ্মীব্রত করাতেই তাঁদের সংসারের সব দুঃখ ঘুচে গেল। ফলে লক্ষ্মীব্রতের কথা অবন্তী নগরে প্রচারিত হয়ে গেল। একদিন অবন্তীর সধবারা লক্ষ্মীপূজা করছেন, এমন সময় শ্রীনগরের এক যুবক বণিক এসে তাদের ব্রতকে ব্যঙ্গ করল। ফলে লক্ষ্মী তার উপর কুপিত হলেন। সেও সমস্ত ধনসম্পত্তি হারিয়ে অবন্তী নগরে ভিক্ষা করতে লাগল। তারপর একদিন সধবাদের লক্ষ্মীপূজা করতে দেখে সে অনুতপ্ত হয়ে লক্ষ্মীর কাছে ক্ষমা চাইল। লক্ষ্মী তাকে ক্ষমা করে তার সব ধনসম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন। এইভাবে সমাজে লক্ষ্মীব্রত প্রচলিত হল।

লক্ষী পুজোর প্রচলিত  আচার 

  • একটি বাঁশের বাঁশিকে সিল্কের কাপড়ে মুড়ে ঠাকুরের সিংহাসনে রাখলে মা লক্ষ্মী প্রসন্ন হন কারণ বাঁশি হল বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়। তাই মা লক্ষ্মীরও অতি প্রিয়।
  • শুধুমাত্র পুজোর দিনে নয়, প্রতিদিনই যদি দেবীর পায়ের চিহ্ন আঁকা ভাল। প্রতিদিন না পারলে বৃহস্পতিবার অথবা শুক্রবার এবং মা লক্ষ্মীর পুজোর তিথি থাকলে তো অবশ্যই।
  •  যিনি প্রতি শুক্রবার পরমান্ন বা মিষ্ট অন্ন দিয়ে গোসেবা করেন তাঁর প্রতি বিশেষ প্রসন্ন হন দেবী।
  • বলা হয় সমস্ত দেবতা বাস করেন তুলসি বৃক্ষে আবার অন্য একটি মত অনুযায়ী দেবী তুলসি হলেন মা লক্ষ্মীরই এক রূপ। তাই বাড়িতে তুলসি বৃক্ষ থাকলে এবং সেখানে প্রতিদিন সেখানে প্রদীপ জ্বাললে তুষ্ট হন মা লক্ষ্মী।
  • প্রতি শুক্রবার পদ্মমূল থেকে তৈরি নয়টি সলতে দিয়ে একটি মাটির প্রদীপ মা লক্ষ্মীর পট বা প্রতিমার সামনে জ্বাললে তা গৃহে প্রাচুর্যের সমাহার ঘটায়।
  • প্রতিদিন স্নান করে শুদ্ধ হয়ে লক্ষ্মী গায়ত্রী মন্ত্র ১০৮ বার জপ করলে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন মা লক্ষ্মী। এই মন্ত্র জপ করার সময় পদ্মবীজের মালা ব্যবহার করলে ভাল।
  •  এছাড়া টানা ৩০ দিন ধরে মা লক্ষ্মীর প্রতিমা বা পটের সামনে নিষ্ঠাভরে শ্রী সুক্ত পাঠ করলে বিশেষ প্রসন্ন হন দেবী। শ্রী সুক্ত হল ১৫টি ভার্সের একটি সম্মেলন। 
  • ঠাকুরঘরে বা ঠাকুরের সিংহাসনে কড়ি এবং শঙ্খ রাখা খুবই শুভ গৃহের কল্যাণের জন্য।
  • দক্ষিণাবর্ত শঙ্খকে বলা হয় মা লক্ষ্মীর শঙ্খ। লাল, সাদা বা হলুদ রংয়ের একটি পরিষ্কার কাপড়, একটি রুপোর পাত্র অথবা মাটির পাত্রের উপর রাখতে হয় এই শঙ্খ। এই শঙ্খের মধ্য দিয়েই মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ প্রবাহিত হয় বাসস্থানে।
  • প্রতিদিন মা লক্ষ্মীর প্রতিমা বা পটের সামনে দু’টি ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালালে তা মঙ্গল। এর সঙ্গে পদ্ম, নারকেল ও ক্ষীরের নৈবেদ্য দিলে প্রসন্ন হন দেবী।
  • ধারাবাহিকভাবে ১২ দিন ধরে সম্পূর্ণ ভক্তিভরে লক্ষ্মী দ্বাদশ স্তোত্র ১২ বার উচ্চারণ করলে ঋণমুক্তি ঘটে।

লক্ষ্মীকে নিয়ে বাংলার জনসমাজে বিভিন্ন জনপ্রিয় গল্প প্রচলিত আছে। এই গল্পগুলি পাঁচালির আকারে লক্ষ্মীপূজার দিন পাঠ করা হয়। একে লক্ষ্মীর পাঁচালি বলে। লক্ষ্মীর ব্রতকথাগুলির মধ্যে “বৃহস্পতিবারের ব্রতকথা” সবচেয়ে জনপ্রিয়। এছাড়াও “বারোমাসের পাঁচালি”-তেও লক্ষ্মীকে নিয়ে অনেক লৌকিক গল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়।

শ্রী শ্রী লক্ষীদেবীর আবাহন 

এস মা লক্ষ্মী, কমল বরণী, কমলালতিকা দেবী কমলিনী-

কমল আসনে, বিরাজ কমলা, কমলময়ী ফসলবাসিনী।।

কমল বসন, কমল ভূষণ, কমনীয় কান্তি অতি বিমোহন।

কোমল করে, শোভিছে কমল, ধাল সিঁদুরে শোভে দেখি শিরে।

কোমল কন্ঠে কমল হারে, কোমল বদন দেখি যে সুন্দরে।।

কমল চরণে কমল নূপুর, কমল অলক্ত মরি কি সুন্দর।

দীন মধুসূদনের সন্তাপ হর তুমি নারায়ণী শান্তিপ্রদায়িনী।।

শ্রী শ্রী লক্ষীদেবীর বরণ 

তুমি মাগো লক্ষ্মীদেবী কমল বরণী।

কমললতিকা কৃপা কর নারায়ণী।।

সাজায়ে রেখেছি মাগো ধান্য-গুয়া-পান।

আসিয়া মাগো কর ঘটেতে অধিষ্ঠান।।

ঘরেতে ধূপ ধূনা আর ঘৃতবাতি।

হৃদয় কমলে ওমা করহ বসতি।।

পদ্মাসনে পদ্মদল রাখি থরে থরে।

শঙ্খ বাদ্যে বরণ করি তোমা ছরে।।

সবে করি লক্ষ্মীপূজা অতি সযতনে।

আশিস করহ মাতঃ আমা সব জনে।।

শ্রী শ্রী লক্ষীদেবীর আবাহন 

এস মা লক্ষ্মী, কমল বরণী, কমলালতিকা দেবী কমলিনী-

কমল আসনে, বিরাজ কমলা, কমলময়ী ফসলবাসিনী।।

কমল বসন, কমল ভূষণ, কমনীয় কান্তি অতি বিমোহন।

কোমল করে, শোভিছে কমল, ধান্যরূপা, মাতঃ জগৎপালিনী।।

কমল কিরিটি মণি মনোহরে, কমল সিঁদুরে শোভে দেখি শিরে।

কোমল কন্ঠে কমল হারে, কোমল বদন দেখি যে সুন্দরে।।

কমল চরণে কমল নূপুর, কমল অলক্ত মরি কি সুন্দর।

দীন মধুসূদনের সন্তাপ হর তুমি নারায়ণী শান্তিপ্রদায়িনী।।

শ্রী শ্রী লক্ষীদেবীর বরণ 

তুমি মাগো লক্ষ্মীদেবী কমল বরণী।

কমললতিকা কৃপা কর নারায়ণী।।

সাজায়ে রেখেছি মাগো ধান্য-গুয়া-পান।

আসিয়া মাগো কর ঘটেতে অধিষ্ঠান।।

ঘরেতে ধূপ ধূনা আর ঘৃতবাতি।

হৃদয় কমলে ওমা করহ বসতি।।

পদ্মাসনে পদ্মদল রাখি থরে থরে।

শঙ্খ বাদ্যে বরণ করি তোমা ছরে।।

সবে করি লক্ষ্মীপূজা অতি সযতনে।

আশিস করহ মাতঃ আমা সব জনে।।