সুকুমার রায় – Sukumar Roy In Bengali

সুকুমার রায় সমগ্র :- 

সুকুমার রায় (১৮৮৭ – ১৯২৩) একজন বাঙালি শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে “ননসেন্স্ রাইমের” প্রবর্তক। তিনি একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার ও নাট্যকার। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সন্তান এবং তাঁর পুত্র খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তাঁর লেখা কবিতার বই আবোল তাবোল, গল্প হযবরল, গল্প সংকলন পাগলা দাশু, এবং নাটক চলচ্চিত্তচঞ্চরী বিশ্বসাহিত্যে সর্বযুগের সেরা “ননসেন্স” ধরণের ব্যঙ্গাত্মক শিশুসাহিত্যের অন্যতম বলে মনে করা হয়, কেবল অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড ইত্যাদি কয়েকটি মুষ্টিমেয় ক্লাসিক-ই যাদের সমকক্ষ। মৃত্যুর আশি বছর পরও তিনি বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয়তম শিশুসাহিত্যিকদের একজন।

গঙ্গা রামকে মনে আছে?  আর কাঠ বুড়ো? কিম্বা কাকেশ্বর কুচ কুচ? এরা হল বাংলা দেশের শিশু সাহিত্যিক দের মধ্যে অন্যতম বিখ্যাত সুকুমার রায়ের সেরা বইগুলির সেরা কিছু চরিত্র, যারা এখনো পর্যন্ত যে কোন বাঙালীর কাছে হাস্যরসের অন্যতম উৎস। সেই সুকুমার রায়ের আজ জন্মদিন। বাংলার আরও এক বিখ্যাত সাহিত্যিক উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরির জ্যেষ্ঠ সন্তান সুকুমার রায় বরাবর ছিলেন সাহিত্য মনস্ক, ও তার ছেলেবেলায় ছিল রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের সহচর্যে ও তার বাবার সাহিত্যমনস্কতার প্রছন্ন আসকারায় বেড়ে ওঠা কবির ভাবনার বাঁধ কোনোদিনও থেমে থাকেনি। বেশ কম বয়েস থেকেই তাঁর লেখা শুরু হয়, এবং বরাবর তাঁর লেখায় ছিলো এক অদ্ভুত কল্পনা, স্বপ্ন আর সত্যির মিশ্রণ। সুকুমার রায়ের সাহিত্য সৃষ্টি ।

আপনার বয়স কত? দশ, বিশ, ত্রিশ? তাতে কোনো সমস্যাই নেই। আপনি যদি ষাট বছরের বৃদ্ধও হন তাতেও কিচ্ছু যায় আসে না, আপনি এখনই স্বচ্ছন্দে সুকুমার রায়ের যেকোনো লেখা নিয়ে পড়া শুরু করতে পারেন। আপনি একটুও বিরক্ত হবেন না, আপনার কাছে কখনো দুর্বোধ্য ঠেকবে না। যেকোনো বয়সের যেকোনো রুচির মানুষকে যিনি আন্দোলিত করতে পারেন তিনি সুকুমার রায়। সেজন্যই বোধ করি বিখ্যাত সংগীত স্রষ্টা কবীর সুমন তাঁর সুকুমার রায়কে নিয়ে লেখা গান ‘সুকুমার রায়’-এ বারবার বলে যান, আমাকে ভাবায় সুকুমার রায় / আমাকে ভাবায় সুকুমার রায়।

গুরুজনদের উপদেশ শুনতে কারোই ভালো লাগে না। কিন্তু উপদেশ যদি দেন সুকুমার রায়, তবে না শুনে উপায় কী! শিশুদের শেখাতে গিয়ে সুকুমার রায় গল্প বলেছেন, ছড়া বলেছেন। গুরুজনদের কাঠখোট্টা উপদেশের বাইরে এসে গল্প-কবিতার ছলে শিখিয়েছেন কী করা উচিত এবং কী অনুচিত। পেন্সিল কামড়ানো কিংবা সিঁড়ি দিয়ে ধুপধাপ করে নেমে জুতা ছিঁড়ে ফেলা একদম ভালো কাজ নয়- এ উপদেশ দিতে গিয়ে সুকুমার রায় লিখে ফেলেছেন একটা আস্ত গল্প ; নাম ‘যতীনের জুতো’। কাউকে হিংসে না করার উপদেশ দিতে গিয়ে লিখেছেন ‘হিংসুটি’। এসব গল্প পড়ে শিশুরা আনন্দ পাবে, হেসে লুটোপুটি খাবে। কিন্তু তারা শিখবে, নিজেরাই বুঝে নেবে তাদের কী করতে হবে।

বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী মারা যাওয়ার পর বিখ্যাত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ভার নেন সুকুমার রায়। ‘সন্দেশ’-এর সম্পাদনার ভার নেয়ার পরই সুকুমার রায় পূর্ণোদ্যমে লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর লেখালেখির বড় অংশই ‘সন্দেশ’ পত্রিকার জন্য। বাংলা শিশুসাহিত্যে ‘সন্দেশ’-এর অবদান অনেক। কেননা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং সুকুমার রায় দুজনই ছিলেন শিশুসাহিত্যিক। বাংলা ভাষায় প্রথম ননসেন্স ছড়া লেখেন সুকুমার রায় এবং ননসেন্স ছড়ার জন্যই সুকুমার রায় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত, ননসেন্স ছড়া হচ্ছে একধরনের ছড়া যা মূলত কৌতুক বা হাস্যরসের জন্য লেখা হয়। কলেজে পড়ার সময় তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘ননসেন্স ক্লাব’। এই ক্লাব থেকে ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামে আরেকটি পত্রিকা বের হতো। ননসেন্স ক্লাবের মতোই আরও একটি ক্লাব গড়ে তোলেন সুকুমার রায়; নাম ‘মণ্ডা ক্লাব’। ‘মণ্ডা ক্লাবের কয়েকটি আমন্ত্রণ পত্র’ সিরিজের কয়েকটি কবিতাও আছে তাঁর।

বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের তুলনা কেবল সুকুমার রায়ই। শিশুসাহিত্য, হাস্যরসে তো বটেই, বিদ্রূপের সুরে সমাজের নানা অসঙ্গতির কথা বলতে পারাতেও তিনি অনন্য ও অসাধারণ। সুকুমার রায় মূলত শিশুসাহিত্যিক ছিলেন; কিংবা বলা যায় সুকুমার রায় কেবল শিশুসাহিত্যিকই ছিলেন। শিশুদের জন্য তিনি লিখেছেন ছড়া, গল্প, নাটক, জীবনীসহ আরও অনেক কিছু। এর বাইরেও লিখেছেন ‘বিবিধ বিষয়’, যা মূলত শিশু-কিশোরদেরকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা জানা-অজানা তথ্য গল্পাকারে বলার প্রয়াস, এবং বলা বাহুল্য, এই প্রয়াসেও তিনি সফল।

সুকুমার রায়ের শিক্ষা জীবন

সূর্য সেন ষ্ট্রীটের সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে পড়ার পর তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে পাশ করেন এবং, কবি ইংল্যান্ডের স্কুল অফ ফোটো এনগ্রেভীং অ্যান্ড লিথোগ্রাফি থেকে ব্লক প্রিন্টিং নিয়ে পড়াশোনা করেন; তিনি এবং তাঁর ছোটো ভাই সুবিনয় রায় একসাথে তাঁর বাবার প্রতিষ্ঠিত ইউ রায় এন্ড সনস এর কাজ করেন। তার সাথে সাথে চলতে থাকে তার সাহিত্য চর্চা, হ য ব র ল, খাই খাই, সন্দেশ পত্রিকা, আবোল তাবোল এই সমস্ত নানান কালজয়ী রচনা তিনি প্রকাশ করতে থাকেন যা আজও বাঙালী মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়।

তিনি মণ্ডা ক্লাব নামের একটি ক্লাবের পতন করেন, যা প্রত্যেক সপ্তাহে তার ই বৈঠক খানায় বসত; এখানে কলকাতার সমস্ত বিখ্যাত লেখকরা থাকতেন, এবং তাদের মধ্যে নানান আলোচনা চলত যে কোন বিষয়ে, যে কোন দেশের। এখানে আগত সমস্ত মানুষের তাদের নিজেদের মতামত জানানোর সমস্ত অধিকার ছিল। এ ছিল এক সব পেয়েছির দেশ। বাংলা সাহিত্য জগতে এমন হাস্যরস সৃষ্টিকারী সাহিত্যিক আর নেই, তার চলচিত্রচঞ্চরি সারা পৃথিবিতে লিউইস ক্যারলের আলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের সমকক্ষ হিসেবে জায়গা পায়। বঙ্গ দেশের এ এক অবিস্মরণীয় সাহিত্যিক।

সুকুমার রায়ের ছড়া-কবিতা

সুকুমার রায়ের সবচেয়ে মজার দিক হচ্ছে তাঁর ছড়া । শিশুদের জন্য লিখলেও তাঁর ছড়া এতটাই প্রাণবন্ত যে সেসব ছড়া বড়দের মুখে মুখেও ঘোরে। সুকুমার রায় তাঁর ছড়ায় শব্দ নিয়ে খেলেছেন, যেমন খুশি তেমন গড়েছেন। তাঁর ছড়া বা কবিতা যেমন বড়দের পড়ার বা বোঝার মতো ভারিক্কি নয়, তেমনি আবার কেবল ছোটদের জন্য লেখা হালকা চালেরও নয়। সুকুমার রায়ের ছড়া-কবিতার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য এটিই।