ভিটামিন ডি এর কাজ ও অভাব জনিত রোগ – Vitamin D Benefits And Deficiency Treatment

প্রথমেই জানা যাক ভিটামিন ডি কী কী কাজে আসে। সে সম্পর্কে ধরণা করে নেওয়া জরুরি। না হলে ঠিক বুঝে উঠতে পারবেন না যে যে এই ভিটামিন টাকে এত গুরুত্ব দেওয়া হয় কেন। নিয়মিত রোদ পোহালে দেহের ভেতরে ভিটামিন ডি – এর ঘাটতি দূর হতে শুরু করে। ফলে হাড় এত শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে যে চোট-আঘাত লাগার আশঙ্কা হ্রাস পায়। সেই সঙ্গে জয়েন্ট, ঘার এবং গোড়ালির কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।

ভিটামিন ডি এর উপকার।

 যেমন- ফাঙ্গাল ইনফেকশন দূরে থাকে, হার্টের স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটে, ঘুম ভাল হয়, ত্বকের রোগ সারাতে সাহায্য করে, ক্যান্সার রোগকে প্রতিরোধ করে, মাল্টিপল স্কলোরোসিস মতো রোগের প্রকোপ কমে এবং শরীরে বাজে কোলেস্টেরলের মাত্রা হ্রাস পায়।

বর্তমানে ভিটামিন ডি গ্রহণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। ভিটামিন ডি-এর অভাবে হাড়ের বিভিন্ন সমস্যার পাশাপাশি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদান ভিটামিন ডি ঘাটতিতে অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যা হতে পারে। হাড়ক্ষয় বা অস্টিওপরোসিস, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ-স্ট্রোক, প্রজনন সমস্যা, পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম ও দৈহিক স্থূলতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের ভিটামিন ডির ঘাটতি থাকতে পারে। শীতপ্রধান দেশগুলোর মানুষের শরীরে ভিটামিন ডি এর  ঘাটতি থাকার ঝুঁকি বেশি থাকে। আর বাংলাদেশের মতো নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে ভিটামিন ডি এর ঘাটতি মূলত অসচেতনতার কারণে।

দেহের মোট চাহিদার ৮০ শতাংশ ভিটামিন ডি আসে সূর্যালোক থেকে। ২০ শতাংশের কম আমরা পেতে পারি খাদ্য উপাদান থেকে, যেমন পোনা, মাগুর, স্যালমন মাছ, দুধ-ডিমে। মূলত ভিটামিন ডি পেতে হলে সূর্যালোকের ওপরই নির্ভরশীল হতে হবে।

ভিটামিন ডি একটি ফ্যাট সলিউবল সিকুস্টারয়েড। যার কাজ হচ্ছে ইনটিসটাইন থেকে ক্যালসিয়ামকে শোষণ করা। পাশাপাশি এটি আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাসকেও দ্রবীভূত করে। ভিটামিন ডি নিয়ে ইদানীং অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। এক সময় আমরা জানতাম ভিটামিন ডি -এর অভাব হলে শিশুদের রিক্যাডস হয় অর্থাৎ দেহের হাড়গুলো ঠিক মতো বৃদ্ধি পায় না, নরম হয়ে যায়, শিশুর বৃদ্ধি হয় না, হাড় বাঁকা হয়ে যায়।

আর এর অভাবে বয়স্ক লোকদের হাড় নরম হয়ে যায়। তবে ভিটামিন ডি শুধু হাড়ের স্বাস্থ্যের সঙ্গেই জড়িত না। আরো অনেক রোগের সঙ্গেও এর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।

ভিটামিন ডি-এর উৎস কী ?

একে দুটো ভাগে ভাগ করা যায়। ডি থ্রি এবং ডি টু। ডি থ্রি প্রকৃতগতভাবে দেহে উৎপন্ন হয়। আমাদের ত্বকের নিচে সেভেন ডি হাইড্রোকোলেস্টেরল নামে একটা পদার্থ থাকে। সূর্যের আলোর আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি যদি আপনার চামড়ার নিচে পড়ে তাহলে এমনিতেই ভিটামিন ডি থ্রি তৈরি হয়। তবে এই রোদ হতে হবে সকাল ৯ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত।

ভিটামিন ডি ৮০ শতাংশ আসে সূর্যের আলো থেকে। বাকি ২০ শতাংশ খাবারে পাওয়া যায়। তবে এই খাবারগুলো আমাদের দেশে প্রচলিত না। যেমন : সামুদ্রিক মাছ, কর্ড মাছ, ম্যাকরিল, সারদিনস। এগুলো আমাদের দৈনন্দিন খাবারের মধ্যে পড়ে না। সবার একটা ধারণা দুধের মধ্যে ভিটামিন ডি আছে। দুধের মধ্যে ক্যালসিয়াম আছে। ভিটামিন ডি-এর মাত্রা কম। এমনকি বুকের দুধের মধ্যেও কম আছে।

ভিটামিন ডি ডিমের মধ্যে আছে। তবে একটি ডিমের মধ্যে হয়তো ২০ থেকে ৩০ ইউনিট থাকতে পারে। কিন্তু কয়টা ডিম আপনি প্রতিদিন খেতে পারবেন?

বয়স ভেদে প্রতিদিনের প্রয়োজনিয়তা মাত্রা রয়েছে। যেমন : এক বছর পর্যন্ত  বয়সে ৬০০ ইউটিন। এক বছর থেকে ৭০ বছর পর্যন্ত ৬০০ থেকে ৭০০ ইউনিট। আর যাদের বয়স ৭০-এর উপরে তাদের দেখা যায় ৭০০ ইউনিটের বেশি লাগছে।

শরীরে ভিটামিন ডির অভাব আছে কি না এটা স্ক্রিনিং করলে বোঝা যায়। এগুলো আমাদের দেশে বিভিন্ন হাসপাতালে করা হয়। ৩০ ন্যানোগ্রামের ওপর যদি থাকে তাহলে পর্যাপ্ত আর যদি ১০ থেকে ২৯ যদি হয় তাহলে অপার্যাপ্ত বলি। আর আসলেই অভাব হবে যদি ১০ এর নিচে থাকে।

ঘাটতি পূরণ করার উপায় কী?

দেহে ভিটামিন ডি-এর ঘাটতি হলে কতগুলো লক্ষণ প্রকাশ পায়। এসব রোগীর শরীর মেজমেজ করে, গাঁটে ব্যথা করে, হাড়ে ব্যথা হয়। বসা থেকে উঠতে গেলে হয়তো শক্তি পায়। আপনি শরীরের সব অংশ ঢেকে রাখলে, রোদ না পেলে ভিটামিন ডি থেকে বঞ্চিত হবেন। যদি কারো স্ক্রিনিং করে দেখা যায় দেহে ভিটামিন ডি অপর্যাপ্ত বা ঘাটতি আছে তাদের আগে ঘাটতি পূরণ করতে হয়। তারপর প্রতিদিন ভিটামিন ডি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার বিষটিতে সচেতন করে তুলতে হয়।

ভিটামিন ডি এর অভাবে কোন রোগ হয়

ভিটামিন ডি এর অভাব জনিত লক্ষণ এবং উপসর্গ

ভিটামিন ডি ঘাটতি অন্যতম গুরুতর অথচ সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এনসিবিআই অনুসারে বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ ভিটামিন ডি ঘাটতিতে ভোগে। মার্কিন ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিনের পরামর্শ অনুযায়ী,গড়ে দৈনিক ১০-২০ মাইক্রোগ্রামের ভিটামিন ডি খাওয়া প্রয়োজন আমাদের।

1. ভিটামিন ‘ডি’র অভাবে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি হয়। ফলে পেশি দুর্বল, হাড় ভঙ্গুর বা ক্ষয় হয়।

2. ইনফেকশন বেড়ে যায়, কাটা বা ক্ষত শুকাতে বিলম্ব হয়।

3. সর্দি-কাশি, টনসিলের প্রদাহ, শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পায়।

4. বিষণ্নতা, ক্লান্তি ও অবসাদে ভোগে, কাজে অনীহা আসে।

5. বাত ব্যথা, বিশেষ করে ব্যাক পেইন বা পেছনের দিকে ব্যথা হয়।

6. কিডনি রোগীদের জটিলতা বাড়ে।

7. উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, স্ট্রোক, টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস ইত্যাদির ঝুঁকি বেড়ে যায়।

8. শিশুদের শরীরের হাড়গুলো ঠিকমতো বৃদ্ধি পায় না। তাদের হাড় নরম বা ভঙ্গুর অথবা বেঁকে যায় (রিকেটস), বড়দের হাড়ের গঠনে বিকৃতি (অস্টিওম্যালেশিয়া) দেখা দেয়।

9. তীব্র হাঁপানি (অ্যাজমা), দীর্ঘস্থায়ী ফুসফুসের সংক্রমণ হয়।

9. গর্ভধারণে জটিলতা বাড়ে।

10. ত্বকের রোগ সোরিয়াসিস বা ত্বকের ক্যান্সার হতে পারে।

11. কারো কারো ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চুল পড়ে

12. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।

13. মস্তিষ্কের স্মৃতিধারণ ক্ষমতা বা কগনেটিভ ফাংশন অব মেমোরি কমে যায়। স্মৃতিভ্রংশ (আলঝেইমার) হয় বা স্মৃতিশক্তি লোপ পায়।

14. যারা পর্যাপ্ত ভিটামিন ‘ডি’ গ্রহণ করে না তাদের মৃত্যুর হার বেশি।

ভিটামিন ডি টেস্ট, সমস্যা ও সমাধান

ভিটামিন ‘ডি’ আমাদের শরীরে হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখে। হাড় ভালো রাখতে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন। কিন্তু ক্যালসিয়ামসমৃদ্ধ খাবার আর ওষুধ হিসেবে ক্যালসিয়াম গ্রহণ করলেই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কারণ শরীরে ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য ভিটামিন ‘ডি’ প্রয়োজন। ভিটামিন ‘ডি’র অভাবে প্রাপ্তবয়স্কদের অস্টিওম্যালেশিয়া হতে পারে। এটির ফলে হাড়ের গঠনে বিকৃতি দেখা দেয়। ভিটামিন ‘ডি’র অভাবের জন্য জীবনযাপনজনিত অভ্যাসও দায়ী। দুধ কম খাওয়া বা শরীরে রোদ না লাগানো বা এয়ারকন্ডিশনড গাড়িতে যাতায়াত করা বা সারা দিন ঘরে বসে কাজ করার ফলে এ রকম হতে পারে। বয়স্ক মানুষ শীতকালে একেবারেই বাইরে না বেরোলে তাদেরও ভিটামিন ‘ডি’র অভাব দেখা দিতে পারে ব্যাপক হারে। তবে দুপুরবেলা কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। বরং সকালের হালকা রোদ কিছুক্ষণ গায়ে লাগতে দিন।

ভিটামিন ‘ডি’র অভাবে হাড় নরম হয়ে যায়। এই অসুখের রোগীরা বারবার পড়ে যান। এতে হাড় ভেঙে যায়। যাঁদের গায়ের রং খুব কালো বা পিগমেন্টেশন বেশি, তাদের শরীরে সূর্যের আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি ঢুকতে বাধা পায়। তাঁরা ভিটামিন ‘ডি’র অভাবজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।

ভিটামিন ডি জাতীয় ফল

সুরক্ষিত কমলার জুস বাজারে কিছু ভালো ব্র্যান্ড রয়েছে, যারা কমলার জুস তৈরিতে ভিটামিন-ডি যোগ করে। অন্যান্য জুসের মধ্যে এটি দেওয়া হলেও কমলার জুস ভিটামিনের উপাদান ধরে রাখতে পারে। তাই ভিটামিন-ডি’র জন্য ভালো ব্র্যান্ডের জুসও খাওয়া যেতে পারে। তবে খাওয়ার আগে প্যাকেটের গায়ে দেখে নিন, কী কী উপাদান দিয়ে তৈরি হয়েছে এটি।

ভিটামিন ডি এর প্রয়োজনীয়তা

1. দেহে অপর্যাপ্ত ভিটামিন ডি এর কারণে দীর্ঘস্থায়ী ব্যাথা থাকে শরীরে।

2. ভিটামিন ডি এর অভাবগ্রস্থ মানুষের মাঝে মধ্যেই মাড়ি ফুলে যাওয়া, লাল হয়ে থাকা এবং রক্তপাত দেখা যায়।

3. হাড়, পেশী ও দাঁত ছাড়াও হার্ট ও ভিটামিন ডি এর উপর নির্ভরশীল। তাই যদি রক্তচাপের মাত্রা বেড়ে যায় তাহলে তা ভিটামিন ডি-এর অভাবে হতে পারে।

4. দিনের বেলা কাজের শক্তি না পাওয়া বা ঘন ঘন একটানা ক্লান্তিবোধ দেখা গেলে বুঝতে হবে তার দেহে ভিটামিন ডি এর মাত্রা কম।

5. দেহের চর্বি কোষে সঞ্চিত ভিটামিন ডি হচ্ছে চর্বিতে দ্রবনীয় ভিটামিন। তাই বেশি ওজনের বা মোটা মানুষের বেশি ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন হয়।

6. দেহে পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি থাকলে উল্লেখযোগ্য হারে অ্যালার্জির মাত্রা কমে যায়। প্রায় ৬০০০ মানুষের উপর পরিচালিত একটি সমীক্ষায় দেখা যায় ভিটামিন ডি এর মাত্রা যাদের কম থাকে তারা বেশি অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হন।

7. ভিটামিন ডি এর প্রধাণ উত্স হল সূর্য রশ্মি। সূর্যের আলো থেকে পর্যাপ্ত পরিমান ভিটামিন ডি পাওয়া সম্ভব। সূর্যের আলো থেকে দেহে ভিটামিন ডি তখনই তৈরি হয় যখন সানস্ক্রিন দেয়া না থাকে। তাই সূর্য রস্মি থেকে ভিটামিন ডি নিতে হলে কমপক্ষে ১০-১৫মিনিট রোদে থাকতে হবে।

ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্য

ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খুব কম। যদি শরীরে এই ভিটামিনের অভাবে সমস্যা হয় তবে এই ভিটামিন সমৃদ্ধ খাবারগুলি বেশি পরিমানে খেতে হবে। স্যালমন, সার্ডিন , টুনা, ম্যাকরেল ইত্যাদি চর্বিযুক্ত মাছ, মাশরুম, কমলা লেবু, ডিম, দুধ ও বাঁধাকপি থেকে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়।

ভিটামিন ডি কিনে খাওয়া শুরু করে সেটি ঠিক হবে কি না ?

নিজে নিজে ওষুধ কিনে খেলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ  ছাড়া  ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট সেবন করা উচিত না। আর সবচেয়ে ভালো হয় যদি সূর্যের আলো থেকে ভিটামিন ডি গ্রহণ করা যায়।