বর্ষাকাল অনুচ্ছেদ রচনা – Rainy Season Paragraph in Bengali Language

বর্ষাকাল অনুচ্ছেদ রচনা ৩য় শ্রেণী ৫ম শ্রেণী – Rainy Season Paragraph in Bengali Language

আমাদের ভারত বর্ষ তথা পুরো বাংলায় ঋতু হলো ছয়টি। তারমধ্যে বর্ষা কাল হলো দ্বিতীয়। বসন্তকে ঋতু রাজ বলা হলেও রূপের ও সৌন্দর্যের দিক দিয়ে বর্ষাকালি শ্রেষ্ঠ।বাংলা আষাঢ় ও শ্রাবন এই মাস নিয়ে হয় বর্ষাকাল। তবে এর ব্যাপ্তি আরো বিস্তৃত। গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ আর প্রখর রোদের পর ঘন গৌরবে নব যৌবনে আসে বর্ষা। ষড়ঋতুর লীলার মাঝে বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্যে বর্ষাকাল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। বসন্তকে ঋতুরাজ বললেও রূপের গৌরব ও প্রকৃতির সৌন্দর্যের জন্য বর্ষাই প্রকৃতির রাণী। বর্ষার আগমনে খাল-বিল জলমগ্ন হয়ে যায়। ব্যাঙেরা দলবেঁধে ডাকতে থাকে মেঘ হ মেঘ হ, নবজীবনের আনন্দমেলা শুরু হয়। ইতিমধ্যে গত কয়েকদিন রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ঘনিয়ে আসা মেঘপুঞ্জ আর বৃষ্টির মধুর বিড়ম্বনা বর্ষার আগমন বার্তা অবশ্য দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছে। রিমঝিম বর্ষায় দীঘল কর্মহীন দিবস-রজনীতে উদাস মনের তোলপাড়ে ঘরে বসে গ্রামীণ নারীর কখনও কাঁথা সেলাই, কিংবা তরুণ মনে তপ্ত দীর্ঘশ্বাসে দু’জনাকে মুখোমুখি করে এই বর্ষা।

আবহমান বাংলার চিরায়ত বর্ষার রূপ-রস এবং সৌন্দর্য ও প্রকৃতি বিচারে আরও বলা যায়, তাপবিদগ্ধ তৃষিত ধরা নববর্ষার সিঞ্চনে সিক্ত হওয়ার দিন এসেছে। বাঙালির প্রেমকাতর হৃদয় নব-বরিষার ছোঁয়ায় সিক্ত হওয়ার পাশাপাশি হবে আরও সমৃদ্ধ। বৃষ্টির শব্দে মহাকবি কালিদাসের যক্ষ্মের মতোই বাঙালির হৃদয় এক অজানা বিরহে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। আর তাই বর্ষা হয়ে উঠেছে ঋতুর রানী।

এই বর্ষার আগমনে প্রেমিক কবিরাও আবহমানকাল ধরেই উচ্ছলিত-বিচলিত। বাঙালি অনেক বিখ্যাত কবির প্রিয় ঋতু বর্ষা। বাংলা ভাষার অমর কাব্য ‘মেঘদূত’-এর মহাকবি কালিদাস তো এই আষাঢ়স্য প্রথম দিবসেই বিরোহী যক্ষ্ম মেঘকে দূত করে সুদূর দুর্গম কৈলাশ শিখরে পাঠিয়েছিলেন বিরোহিনী প্রিয়ার কাছে। তিনি এই আষাঢ়েই চিরায়ত কাব্যগ্রন্থ মেঘদূত রচনা করেন।

প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আষাঢ়কে বলেছেন ‘ধ্যানমগ্ন বাউল-সুখের বাঁশি।’ অন্যদিকে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখেছেন ধ্রুপদী সেই পঙ্ক্তি- ‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর/উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর।’

বাঙালির অতি প্রিয় এই ঋতুর আগমনে পুরো প্রকৃতি তার রূপ ও বর্ণ বদলে ফেলে। গাছপালা, তরুলতা সবকিছুই যেন গ্রীষ্মের দহন থেকে পরিতৃপ্তি পেতে স্নান করে ওঠে। পেখম মেলে নৃত্য করে ময়ূর।

আষাঢ় যেন প্রকৃতির এক আশীর্বাদ। কবিগুরুর কাব্যভাণ্ডারের বহু ছত্রে কেবল বর্ষা আবাহনের পঙ্ক্তি : ‘হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচেরে, আকুল পরান আকাশে চাহিয়া উল্লাসে কারে যাচে রে।’

কিংবা ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে/তিল ঠাঁই আর নাহিরে/ওগো আজ তোরা/যাসনে ঘরের বাহিরে।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আষাঢ়সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, গেল রে দিন বয়ে/বাঁধনহারা বৃষ্টিধারা ঝরছে রয়ে রয়ে।’

বর্ষা নিয়ে নবযৌবন আর যৌবনের কবিদের অমরগাথা থাকলেও একে নিয়ে আবার অনুযোগেরও কমতি নেই। কাব্যলক্ষ্মীর সাধনায় যাদের আগ্রহ কম তাদের অনেকের কাছে বর্ষা ভোগান্তিরও বটে। কেননা আষাঢ় মানেই বৃষ্টির ঘনঘটা। বৃষ্টির তোড়ে যাওয়া যায় না ঘরের বাইরে।

বিশেষ করে নগরে রাস্তায় বের হওয়া অনেক সময়ে চরম দুর্ভোগই নিয়ে আসে। কমে যায় দিনমজুরের আয়-উপার্জন। গ্রামাঞ্চলেও অনেক সময়ে কাজে ব্যাঘাত ঘটে। তবে বর্ষা নিয়ে যাই চলুক আর ঘটুক প্রকৃতির গভীর আহ্বান ও নিষ্ঠুর বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় করেই চলছে বাঙালি মনন।

এদিকে বাস্তবে আষাঢ় নিয়ে তপস্যা আর বিরহ যা-ই থাকুক, বর্ষা ঋতুকে বরণ করে নিতে প্রতি বছরের মতো এ বছরও বর্ষা উৎসবের আয়োজন করেছে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন। বর্ষাপ্রেমীদের আজ মনেপ্রাণে বেজে উঠবে সেই সুর- ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে, পাগল আমার মন জেগে ওঠে।’

প্রতিবছরই বৈশাখ মাসের শুরুতে কালবৈশাখী ঝড় হয়। সেই ঝড়ের ভয়াবহতা গেল বছর নানা বাড়িতে গ্রীষ্মের ছুটিতে গিয়ে আমি প্রথম প্রত্যক্ষ করি, সেই বৈশাখীর দিনের সকালের আকাশটা ছিল সুন্দর। দুপুরের আকাশেও কালো মেঘের কোনো চিহ্ন ছিল না। সারা দিনের প্রচণ্ড গরমে নিজেই প্রত্যাশা করছিলাম বায়ুবেগে একখণ্ড মেঘ একটু বাতাসের ঝাপটা আর সেই সাথে কিছু বৃষ্টি। আমার এ প্রত্যাশা ব্যর্থ হলো না। আমি তখন ঘরে বসে হারিকেন জ্বালিয়ে গল্পের বই পড়ছিলাম। এমন সময় সোঁ সোঁ শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝলাম বাতাস উঠেছে। আনন্দে ঘর থেকে দৌড়ে বের হলাম আম কুড়ানোর জন্য। দেখলাম সমস্ত বায়ুমণ্ডল যেন ধুলার সমুদ্র। ওরই মধ্যে কাপড়ের কোঁচা ভর্তি করে আম কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত বৈঠকখানার ঘরে ঢুকলাম। ঝড়ের রূপ তখন ভয়াবহ, সেই সঙ্গে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি। বাতাসের ঝাপটায় এক-একবার মনে হতে লাগল, এই বুঝি পুরো ঘরটি উড়িয়ে নিয়ে যাবে। পশ্চিম দিকের ঘরের চাল হঠাৎ আলগা হয়ে গেল। চোখের পলকে পেছনের চালটাও উড়ে গেল। আমরা সবাই ভয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। গোয়াল ঘরে গরুর হাম্বা ডাক, মানুষের আর্তচিৎকার, বাতাসের ঝাপটা, সব মিলিয়ে মনে হলো যেন কিয়ামত শুরু হয়ে গেছে। নানা জোরে শব্দ করে আজান দিতে লাগলেন। মামা চিৎকার করে সবাইকে খাটের নিচে আশ্রয় দিতে বললেন। আমরা তাই করলাম। এভাবে কতক্ষণ ঝড় চলেছে বুঝতে পারিনি। ঝড় থামার পর হারিকেন নিয়ে সবার সঙ্গে বাইরে গিয়ে দেখলাম ঘরের ওপরের কৃষ্ণচূড়া গাছটা ভেঙে দু্ই টুকরো হয়ে উঠোনে পড়ে আছে। বরই গাছে ঝুলছে ঘরের টিনটা। একটা ঘুঘু পাখি উঠোনে মরে পড়ে আছে। সে রাতের ঝড়ের কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। সে সন্ধ্যায় আমি বুঝেছি, প্রকৃতির প্রচণ্ডতার কাছে মানুষ কত অসহায়, কত নিঃস্ব।
বর্ষাকাল ঋতু বৈচিত্র্যের এ বাংলাদেশে গ্রীষ্মের খরতাপ ও রিক্ততায় অবসানের জন্যই শ্যাম সমারোহে বর্ষা আসে আষাঢ়, শ্রাবণ মাস নিয়ে। নিরস ও দঙ্ময় গাছপালা পল্লবিত হয়ে নতুন জীবন লাভ করে। নদী-নালা, খাল-বিলও বর্ষার পানিতে থৈ থৈ করে। প্রকৃতিতে কদম, জুঁই, চামেলি, শাপলা, পদ্মসহ নাম না জানা ফুল যেমন ফোটে, তেমনি দশদিক আমোদিত হয় আম, কাঁঠাল, জাম, আনারসের সুগন্ধে। দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের ক্ষেতে এক নতুন প্রাণের হিল্লোল সঞ্চারিত হয়। বর্ষার আবির্ভাব কেবল প্রকৃতির বুকে নতুন প্রাণের স্পন্দন জাগায় না, কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের কৃষককুলের সঙ্গে বর্ষার রয়েছে সুমধুর সম্পর্ক। এ সময় কৃষকদের মধ্যে ধান রোপণের হিড়িক পড়ে যায়। এ ছাড়া এ সময়েই তারা আউশ ধান ও সোনালি আঁশ পাট ঘরে তোলে। পানিবাহিত রোগ-ব্যাধিরও ব্যাপক প্রাদুর্ভাব ঘটে। তার পরও ধান, পাট ইত্যাদি ফসলের সম্ভাবনা কৃষককুলের মনে-প্রাণে বয়ে আনে আনন্দের বার্তা। বর্ষার পানিতে লোকেরা এ সময় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে গ্রামীণ জীবনে শ্রী-সমৃদ্ধি সচ্ছলতা এলেও শহরাঞ্চলে পানি জমে ওঠার কারণে নিম্নাঞ্চল ডুবে যায়। উপর্যুপরি বৃষ্টির কারণে মৌসুমি বেকারত্বের সৃষ্টি হয়। তাই বর্ষা এ দেশবাসীর জীবনমৃত্যু এবং আশা-নিরাশার প্রতীক, তাদের জীবনেরই প্রতিরূপ