প্রেম ও বিরহের বর্ষাকাল

আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে – Aji Jhoro Jhoro Lyrics

আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
          জানি নে, জানি নে
 কিছুতেই কেন যে মন লাগে না ।।

এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে
     উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ঐ বলাকার পথখানি নিতে চিনে ।।

মেঘমল্লারে সারা দিনমান
বাজে ঝরনার গান ।

মন হারাবার আজি বেলা
    পথ ভুলিবার খেলা
    মন চায় …মন চায় …
হৃদয় জড়াতে কারো চির -ঋণে

আজি ঝর ঝর মুখর বাদল দিনে . . .
জানি নে জানি নে … কিছুতে কেন যে মন লাগে না

বর্ষা এলে প্রকৃতি সাজে নতুন সাজে। তৃষিত হৃদয়ে, পুষ্পে-বৃক্ষে, পত্র-পল্লবে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। নূপুর পায়ে ঝুমুর ঝুমুর তালে ঝরে পড়া অঝোর ধারার বৃষ্টিতে ভিজতে থাকে উন্মুখ –অধীর প্রকৃতি। বৃষ্টির ধারায় উপছে পড়ে বাংলার ডোবা-নালা-মাঠ-ঘাট-পুকুর-বিল-হাওর। ঝরঝর নির্ঝরণীতে মানুষের মনকে যুগপৎ আনন্দ-বেদনা ও বিরহকাতরতায় সিক্ত করে তুলে বর্ষা।

গাছের ডালে, পাতার ফাঁকে চুপচাপ বসে থাকে পাখিরা। জনশূন্য মাঠ-ঘাট জনশূন্য পথ-প্রান্তর। কখনো জনশূন্য পথের ধারে দাঁড়িয়ে বেভুলো রাখালের সাদা গাভিটি ভিজে একাকার। গাঁয়ের পুকুর অথবা নদীতে বৃষ্টির ফোঁটায় সৃষ্টি হয় ধূসর বরণ কুয়াশা কণার। উঠোনে জমে ওঠে পানি। সে পানির ঘোলা স্রোত নামে ঢাল বেয়ে। পুলকে আকুপাকু করে ওঠে শিশুদের মন। সহসা খাতার কাগজ ছিঁড়ে তারা তৈরি করে কাগজের নৌকা। সে নৌকা ভাসিয়ে দেয় উঠোনের পানিতে।

গ্রীষ্মের তাপদাহে প্রকৃতি যখন অস্থির হয়ে ওঠে। যখন খাঁ খাঁ রোদ্দুরে পোড়া থাকে মাঠ-ঘাট, গরমে হাসফাঁস জীবন,তলা শুকনো জলাশয়। যখন তৃষ্ণার্থ চাতকের বৃষ্টির জন্য করুণ আকুতি। মানুষের মনও ব্যাকুল বিনয়ে শ্রষ্ঠার কাছে প্রার্থনা করে, আল্লাহ মেঘ দে পানি দে, ছায়া দে রে তুই….। তখন তৃষ্ণার্থ প্রকৃতিকে অমৃতসুধায় ভরিয়ে দিতে রিমঝিম বৃষ্টি, একরাশ সজীবতা আর কদমফুলের সুভাষ নিয়ে আসে বাঙালির প্রিয় ঋতু বর্ষা।

চারদিকে থৈ থৈ পানি। পানিতে ভরে ওঠা নদী-নালায় আবার ভাসে পালতোলা নাও। খালে –বিলে দস্যিছেলের দল কলা গাছের ভেলা ভাসিয়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায়। ডোবা নালার ঘোলা জলে হাপুস হুপুস ডুব সাঁতারে মেতে ওঠে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা। এই টাপুর টুপুর বৃষ্টিতেই ধুয়ে মছে পরিষ্কার হয়ে যায় সবকিছু। তখন ভেজা মাটির গন্ধে মন যেন কেমন করে ওঠে। বড় আপন মনে হয় মা ও মাটিকে।

বর্ষার জলে খাল, ডোবা, বিলঝিল, নদীনালার কাদা পানির তলায় গর্ত করে লুকিয়ে থাকা ছোট–বড় নানা জাতের মাছ বেরিয়ে আসে।ওপর থেকে ঢাল বেয়ে হালকা পানির স্রোতে চলে আসে কৈ, শিঙ ও পুঁটি টেংরা মাছের ঝাঁক। কদম, কেয়া, জুঁই, চামেলী ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা থাকে ফুলবন। সতেজ গাছপালার সবুজ রূপ বাংলাদেশকে এক অপরুপ সাজে সাজায়। সবুজে সবুজে ভরিয়ে দেয় প্রকৃতি আর পরিবেশ।

প্রেমের কবি নজরুলের কবিতায়ও বর্ষা ধরা দিয়েছে প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। বর্ষার মেঘ যেন তার বিরহ-বেদনাকে আরও বেশি উসকে দিয়েছে। তাইতো তিনি তার কবিতার মাধ্যমে বাদল রাতের পাখিকে বন্ধু ভেবে আর বিরহের সঙ্গে নিজের বিরহ একাকার করতে চেয়েছেন। তিনি বর্ষাকে ভেবেছেন তার দুঃখ যাতনার সারথী হিসাবে। সে কারণেই হয়তো বর্ষাবিদায় কবিতায় ঝরে পড়ে কবিমনের যত আকুতি।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তেমনিভাবে পল্লী কবি জসিম উদ্দিন, আল মাহমুদ, সৈয়দ সামসুল হক, কবি ওমর আলী, নির্মলেন্দু গুন, আসাদ চৌধুরীসহ বাংলা-দেশের সমকালীন কবিদের কবিতায় বর্ষা বন্দনা ফুঠে ওঠেছে অনবদ্যভাবে। বর্ষায় মানুষের হৃদয় যেন ভালবাসার এক অজানা আহ্বানে উদ্বেলিত হয়ে উঠে। তাই বর্ষাকে ভালবাসার ঋতু হিসেবে আখ্যায়িত করে অনেকে।

বৃষ্টির সাথে আমাদের প্রেম সেই আদিকাল থেকেই। বৃষ্টি আমাদের হাসায়, কাঁদায় , আবেগে আপ্লুত করে। বৃষ্টিতে জমে ওঠে অনন্য প্রেম। তাই বৃষ্টির দিন বর্ষা যেন আমাদের প্রেম –বিরহ – ভালবাসার ঋতু। বর্ষা মানেই জলনূপুরের গান, বর্ষা মানেই জলে ভেজা পৃথিবী, বর্ষা মানে বৃষ্টিস্নাত এক রমনীয় বাংলাদেশ।