নজরুলের প্রেমের কবিতা

নমস্কার বন্ধুরা আর সবাইকে আমার তরফ থেকে Happy New Year .নতুন বছর সবার ভালো কাটুক সুস্থ কাটুক এই কামনা করি। আমরা নজরুল কে তো সবাই চিনি ও জানিও। তাই আজ নজরুলের বেশ কিছু আবেগ ভরা প্রেমের কবিতার ডালি নিয়ে এসেছি আপনাদের কাছে। কবি নজরুল আমার কাছে যতটা না বিদ্রোহী কবি হিসাবে রয়েছেন তার থেকে অনেক বেশি প্রেমের কবি হিসাবে পরিচিত।

কাজী নজরুল ইসলাম সবচেয়ে বেশি খ্যাতি পেয়েছেন বিদ্রোহী কবি হিসেবে, কিন্তু এর বাইরেও তিনি প্রেম ও প্রকৃতিরও কবি। যদিও প্রেম ও বিদ্রোহ বৈপরিত্যপূর্ণ, কিন্তু কবির কাছে বুঝি তা হার মেনেছে। তিনি এই দুটো জিনিস সন্তরালে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। আর এ কারণেই বুঝি তাঁর কবিতা ও গানে আমরা একই সঙ্গে পাই প্রেমিক ও বিদ্রোহী সত্তাকে। বিদ্রোহী কবিতায় আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর হাতে রণতূর্য’। প্রেম ও বিদ্রোহ যে সমানতালে চলতে পারে তার প্রমাণ মিলতে এই একটি লাইনই বুঝি যথেষ্ট। এই দ্রোহ এবং প্রেমকে ধারণ করে এমন স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ কেবল নজরুলের পক্ষেই সম্ভব।

রৌদ্রোজ্জ্বল ঝড়া দিনের শেষে আধো আলো ছায়ার গোধূলি যেন মনে রঙ ছড়ায়। ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকা পরিবেশ মৃদু বাতাস আরও বেশি মনকে আন্দোলিত করে তোলে। এমনই মায়া ভরা গ্রামীণ পরিবেশে ভেসে আসা বাঁশির সুরে মন হারিয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। এমনই এক ঘটনার মধ্য দিয়ে জীবনে প্রথম প্রেমের সূত্রপাত ঘটে সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলামের। ঘটনাবহুল জীবনে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, শেষ জীবনে নির্বাক হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি। স্বল্প কর্মময় জীবনে যে ছাপ তিনি রেখে গেছেন তা হিসেব করলে আজও চমকে উঠতে হয়। কি করে একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব এমন অসাধারণ সৃজনশীল সৃষ্টি উপহার দেয়া? যা আজও পর্যন্ত কোন মানুষ তাঁর রেখে যাওয়া সৃষ্টি সম্পূর্ণ আত্মস্থ করতে পারেনি। ধারণা করা হয় এখনও অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে তাঁর অনেক সৃষ্টি। আর এ ধারণার অন্যতম কারণ হচ্ছে মাঝে মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে অপ্রকাশিত গান-কবিতার সন্ধান পাওয়া।

কবির জীবনে প্রেম এসেছে বারবার। এই প্রেমেই তার কবিতা এবং গানের অন্যতম প্রেরণাদায়ক। আবার প্রেমে ব্যর্থ কবি হৃদয়ে বেজে উঠেছে বিরহের সুর। কবির জীবনে প্রেমের অধ্যায়ে বহু নারীর কথা উঠে আসলেও মূলত তিনজনের কাছে কবির প্রেম নিবেদনের প্রমাণ মেলে। এরা হলেন নার্গিস, প্রমীলা এবং ফজিলাতুন্নেসা। এর মধ্যে প্রমীলাকে নিজ ভুবনে আবদ্ধ করতে পারলেও বাকি দু’জনকে যেন পেয়ে হারিয়েছেন বারবার। আমরা এখন সেই বিদ্রোহী তথা প্রেমিক কবির কিছু নজরুলের প্রেমের কবিতা দেখে নেবো।

তোমারে পড়িছে মনে
আজি নীপ-বালিকার ভীরু-শিহরণে,
যুথিকার অশ্রুসিক্ত ছলছল মুখে
কেতকী-বধূর অবগুন্ঠিত ও বুকে-
তোমারে পড়িছে মনে।
হয়তো তেমনি আজি দূর বাতায়নে
ঝিলিমিলি-তলে
ম্লান   লুলিত অঞ্ছলে
চাহিয়া বসিয়া আছ একা,
বারে বারে মুছে যায় আঁখি-জল-লেখা।
বারে বারে নিভে যায় শিয়রেরে বাতি,
তুমি জাগ, জাগে সাথে বরষার রাতি।

সিক্ত-পক্ষ পাখী
তোমার চাঁপার ডালে বসিয়া একাকী
হয়ত তেমনি করি, ডাকিছ সাথীরে,
তুমি চাহি’ আছ শুধু দূর শৈল-শিরে ।।
তোমার আঁখির ঘন নীলাঞ্জন ছায়া
গগনে গগনে আজ ধরিয়াছে কায়া । …

আজি হেথা রচি’ নব নীপ-মালা–
স্মরণ পারের প্রিয়া, একান্তে নিরালা
অকারণে !-জানি আমি জানি
তোমারে পাব না আমি। এই গান এই মালাখানি
রহিবে তাদেরি কন্ঠে- যাহাদেরে কভু
চাহি নাই, কুসুমে কাঁটার মত জড়ায়ে রহিল যারা তবু।
বহে আজি দিশাহারা শ্রাবণের অশান্ত পবন,
তারি মত ছুটে ফেরে দিকে দিকে উচাটন মন,
খুঁজে যায় মোর গীত-সুর
কোথা কোন্‌ বাতায়নে বসি’ তুমি বিরহ-বিধুর।
তোমার গগনে নেভে বারে বারে বিজলীর দীপ,
আমার অঙ্গনে হেথা বিকশিয়া ঝরে যায় নীপ।
তোমার গগনে ঝরে ধারা অবিরল,
আমার নয়নে হেথা জল নাই, বুকে ব্যথা করে টলমল।

আমার বেদনা আজি রূপ ধরি’ শত গীত-সুরে
নিখিল বিরহী-কন্ঠে–বিরহিণী–তব তরে ঝুরে!
এ-পারে ও-পারে মোরা, নাই নাই কূল!
তুমি দাও আঁখি-জল, আমি দেই ফু

যারে হাত দিয়ে মালা দিতে পার নাই
কেন মনে রাখ তারে
ভুলে যাও তারে ভুলে যাও একেবারে।
আমি গান গাহি আপনার দুখে,
তুমি কেন আসি দাড়াও সুমুখে,
আলেয়ার মত ডাকিও না আর
নিশীথ অন্ধকারে।

দয়া কর, মোরে দয়া কর, আর
আমারে লইয়া খেল না নিঠুর খেলা;
শত কাঁদিলেও ফিরিবে না সেই
শুভ লগনের বেলা।

আমি ফিরি পথে, তাহে কর ক্ষতি,
তব চোখে কেন সজল মিনতি,
আমি কি ভুলেও কোন দিন এসে দাঁড়িয়েছি তব দ্বারে।

ভুলে যাও মোরে ভুলে যাও একেবারে।

হে মোর রানী ! তোমার কাছে হার মানি আজ শেষে।
আমার বিজয়-কেতন লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
আমা সমর-জয়ী অমর তরবারী
দিনে দিনে ক্লান্তি আনে, হ’য়ে উঠে ভারী,
এখন এ ভার আমার তোমায় দিয়ে হারি
এই হার-মানা-হার পরাই তোমার কেশে।।

ওগো জীবন – দেবী!
আমায় দেখে কখন তুমি ফেল্‌লে চোখের জল,
আজ বিশ্ব –জয়ীর বিপুল দেউল তাইতে টলমল!

আজ বিদ্রোহীর এই রক্ত রথের চূড়ে,
বিজয়ীনি! নীলাম্বরীর আঁচল তোমার উড়ে,
যত তুণ আমার আজ তোমার মালায় পুরে,
আমি বিজয়ী আজ নয়ন জলে ভেসে’।

‘জাগিলে পারুল কিগো ‘সাত ভাই চম্পা’ ডাকে,
উদিলে চন্দ্র-লেখা বাদলের মেঘের ফাঁকে।।
চলিলে সাগর ঘু’রে
অলকার মায়ার পুরে,
ফোটে ফুল নিত্য যেথায়
জীবনের ফুল্ল-শাখে।।
আঁধারের বাতায়নে চাহে আজ লক্ষ তারা,
জাগিছে বন্দিনীরা, টুট ঐ বন্ধ কারা।
থেকো না স্বর্গে ভুলে,
এ পারের মর্ত্য কূলে,
ভিড়ায়ো সোনার তরী
আবার এই নদীর বাঁকে।।

বাদল বায়ে মোর
নিভিয়া গেছে বাতি।
তোমার ঘরে আজ
উৎসবের রাতি।।
তোমার আছে হাসি,
আমার আঁখি-জল
তোমার আছে চাঁদ,
আমার মেঘ-দল,
তোমার আছে ঘর,
ঝড় আমার সাথী।।

শুন্য করি’ মোর
মনের বন ভূমি
সেজেছ সেই ফুলে
রানীর সাজে তুমি।
নব বাসর ঘরে
যাও সে সাজ প’রে,
ঘুমাতে দাও মোরে
কাঁটার শেজ্‌ পাতি।

পরজনমে দেখা হবে প্রিয়
ভুলিও মোরে হেথা ভুলিও।।
এ জনমে যাহা বলা হ’ল না,
আমি বলিব না, তুমিও বলো না।
জানাইলে প্রেম করিও ছলনা,
যদি আসি ফিরে, বেদনা দিও।।

হেথায় নিমেষে স্বপন ফুরায়
রাতের কুসুম প্রাতে ঝরে যায়,
ভালো না বাসিতে হৃদয় শুকায়,
বিষ-জ্বালা-ভরা হেথা অমিয়।।

হেথা হিয়া উঠে বিরহে আকুলি,
মিলনে হারাই দু’দিনেতে ভুলি,
হৃদয়ে যথায় প্রেম না শুকায়-
সেই অমরায় মোরে স্মরিও।

শেষ কথা

আবার যদি কখনো দেখা হয়ে যায় কোনো এক বর্ষায় ভালোবেসে দেবো তুলে কদমের ফুল তোমার হাতে ভেবেনিও তুমি এই আমার শেষ আগমন…? নার্গিস, প্রমীলা, ফজিলতুন্নেসা এই তিন নারীই নজরুলের কাছ থেকে প্রেম বলতে আমরা যা বুঝি তা পেয়েছিলেন। এছাড়া নজরুলের জীবনকালে তার সাথে সংশ্লিষ্ট আরো কিছু নারীকে জড়িয়ে কিছু গুজব উঠেছিল বা তাদের প্রতি নজরুলের গভীর আত্মীক আকর্ষণ অনুভবের প্রমান মেলে। বাংলার বিদ্রোহী কবির বাঁধ ভাঙা প্রেমের এই হল সাতকাহন। সৈয়দ আলী আশরাফের ‘নজরুল জীবনে প্রেমের এক অধ্যায়’ গ্রন্থ হতে কিছু অংশ দিয়ে শেষ করছি।“………..তিনি আসলে সৌন্দর্যের পূজারী, ব্যক্তির উপাসক নন। যে নারীর ভিতর সেই সৌন্দর্যের বিকাশ দেখেছেন এবং সে নারী তার মনে সেই পূজার যে আনন্দের অনুভূতি জাগ্রত করেছেন, তাকে পাওয়ার জন্য ন্যায়-অন্যায়, সমাজের বাধা নিষেধ মানতে তিনি রাজী নন। স্তবগান রচনা করতে তিন প্রস্তুত। অর্থাৎ এই প্রণয় হচ্ছে সেই পর্যায়ের প্রণয় যে পর্যায়ে যাকে ভালোবাসা যায় তাকে দেবী বলে মনে হয়, মানুষ হিসেবে গণ্যকরা হয় না। ………….. তিনি এই প্রেমকে কবি হিসেবে উপলব্ধি করেছেন, উপভোগ ক্রএছেন। তাই এই প্রেমে একদিকে দেখি সাময়িক উচ্ছ্বাস, অন্য দিকে দেহি আত্মতৃপ্তি। দুঃখকে উপভোগ করার জন্যই যেন এই প্রেম। ……….. নার্গিস, জাহানারা, ফজিলাতুন্নেসা এদের সঙ্গে তার প্রেম কি একই প্রেমের পুনরুক্তি নয়? শুধু মনে হয় ফজিলতুন্নেসার প্রতি তাঁর অনুরাগ বেশ গভীর হতে পারত কিন্তু সেই গভীরতা অর্জন করার সুযোগ পায়নি।