নেতাজীর জীবনী – Netaji Biography in Bengali

 সুভাষচন্দ্র বসু  (জন্ম: ২৩ জানুয়ারি, ১৮৯৭ – তথাকথিত মৃত্যু: ১৮ অগস্ট, ১৯৪৫ (যদিও এই মত বিতর্কিত) ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক কিংবদন্তি নেতা। তিনি নেতাজি নামে সমধিক পরিচিত।

ভুমিকা

সুভাষচন্দ্র পরপর দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত এবং কংগ্রেসের বৈদেশিক ও আভ্যন্তরিণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা। করার জন্য তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। সুভাষচন্দ্র মনে করতেন গান্ধীজির অহিংসার নীতি ভারতের স্বাধীনতা আনার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। এই কারণে তিনি সশস্ত্র বিদ্রোহের পক্ষপাতী ছিলেন। সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের পূর্ণ ও সত্বর স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাঁকে এগারো বার কারারুদ্ধ করেছিল। তাঁর বিখ্যাত উক্তি “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো।”

ভারতবাসী প্রায় দুশো বছর বৃটিশ সরকারের অধীনে ছিল।এর মধ্যে প্রচুর মনীষা এসেছেন যারা ভারতীয়দের জীবনবোধ এবং দেশকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি , সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিয়েছিলেন।এইসব মহাপুরুষ আমাদের হৃদয়ে এক বিশাল জায়গা জুড়ে আছেন। আর এদের মধ্যে যিনি আমাদের শিরদাঁড়াকে শান দেওয়ার পাঠ দিয়ে গেছেন তাঁর  নাম সুভাষচন্দ্র বসু। সুভাষচন্দ্র বসু , যিনি নিজের শিক্ষকের ভারতবিদ্বেষী মন্তব্যের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন কৈশোরেই।সুভাষচন্দ্র বসু সেই স্বপ্নের নাম যা গোটা দেশকে ভাবতে শিখিয়েছিল ভারতীয়রা যদি চায়, গোটাদেশে স্বরাজ প্রতিষ্ঠা করতেই পারে। নিজস্ব সেনা বাহিনী গড়েও যে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে ভারতীয়রা, তা তিনি প্রমাণ করেছেন। একজন দক্ষ প্রশাসক, আদর্শবাদী নেতা, সর্বোপরি একজন সাহসী মানুষ। চোখের তারায় আগুন জ্বালানো, দাপটকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেলে, মানুষ যে সবার হয়ে যায় তাঁর জ্বলন্ত নজির  নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু । মানুষের মতো মানুষের একটা নাম নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও তাঁর মতাদর্শের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি; বরং এই যুদ্ধকে ব্রিটিশদের দুর্বলতার সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান ভ্রমণ করে ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তার নেতৃত্ব দান করেন। এই বাহিনী সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দী এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুর সহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি নির্বাসিত আজাদ হিন্দ সরকারপ্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে যুদ্ধ পরিচালনা করেন।

জন্ম ও ছেলেবেলা

১৮৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারি কটক শহরে আইনজীবী  জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর কোল আলো করে জন্মগ্রহণ করেন সুভাষচন্দ্র  বসু। জানকীনাথ বসু ছিলেন সে সময়ের বিখ্যাত আইনজীবী। তাঁর মেজ দাদা ছিলেন শরৎকুমার বসু। নেতাজী ছোট্ট থেকেই মেজদার খুব কাছের এবং প্রিয় ছিলেন। তাঁর পড়াশোনার শুরু কটকের একটি ইংরাজি মাধ্যম স্কুলে।ষষ্ঠ শ্রেনী অবধি তিনি সেখানেই লেখাপড়া করেন । তারপর তিনি ভর্তি হন র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে সেখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষাতে কলকাতা থেকে প্রথম হন, সালটা ১৯১১। তারপরের তাঁর যাত্রা কলকাতা শহর জুড়ে। ছোট থেকে বই পড়তে ভালবাসতেন, বিতর্কতে অংশগ্রহণ করতেন ।তিনি ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের গুণমুগ্ধ ভক্ত। কলকাতাতে এসে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন।

প্রথম জীবন

১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জানুয়ারি, বর্তমান ওডিশা রাজ্যের কটক শহরে (ওডিয়া বাজার) জন্মগ্রহণ করেন সুভাষচন্দ্র বসু। তিনি ছিলেন কটক-প্রবাসী বিশিষ্ট বাঙালি আইনজীবী জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সুভাষচন্দ্র একটি কটকের ইংরেজি স্কুলে পড়াশোনা করেন; বর্তমানে এই স্কুলটির নাম স্টুয়ার্ট স্কুল। এরপর তাঁকে ভর্তি করা হয় কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে। সুভাষচন্দ্র ছিলেন মেধাবী ছাত্র। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কলকাতা থেকে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়অধিভুক্ত স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে সাম্মানিকসহ বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

এরপর সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজউইলিয়াম হলে উচ্চশিক্ষার্থে ভরতি হন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়ে তিনি প্রায় নিয়োগপত্র পেয়ে যান। কিন্তু বিপ্লব-সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সেই নিয়োগ প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে [নিজেকে] প্রত্যাহার করে নেওয়া”। এই সময় অমৃতসর হত্যাকাণ্ড ও ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দ দমনমূলক রাওলাট আইন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ভারতে ফিরে সুভাষচন্দ্র ‘স্বরাজ’ নামক সংবাদপত্রে লেখালেখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন বাংলায় উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু যখন কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন, তখন সুভাষচন্দ্র তাঁর অধীনে কর্মরত ছিলেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে অন্যান্য জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে তাঁকেও বন্দি করা হয় এবং মান্দালয়ে নির্বাসিত করা হয়। এখানে তিনি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তিনি ধ্যানে অনেক সময় অতিবাহিত করতেন। স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শ তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ছাত্রাবস্থা থেকে তিনি তাঁর দেশপ্রেমিক সত্তার জন্য পরিচিত ছিলেন।

পড়াশোনা ও কর্মজীবন 

স্কুলে পড়াশোনা করবার সেসময়ই তিনি তাঁর শিক্ষকের হাত ধরে  পরিচিত হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাথে । তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন । পরবর্তীকালে তাঁর হাতেই নেতাজীর রাজনীতির  হাতেখড়ি। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় তিনি এক বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় ,তিনি কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। পরে ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে সেখান থেকে তিনি ১৯১৮ সালে  বি. এ পাশ করেন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতে ভালো ফল করেও তিনি সেই চাকরী নেননি । বৃটিশ সরকারের দাস না হয়ে, তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করাকেই শ্রেয় মনে করায় যোগদান করেন সক্রিয় রাজনীতিতে।

রাজনৈতিক জীবন

আমরা রহস্য খুঁজি, রাজনীতি বুঝি না। তথ্যের উপর নির্ভর করেই ইতিহাস তার ব্যাখ্যা সাজায়। কিন্তু কোন তথ্য আমি ব্যবহার করব, কোনটাকে তত গুরুত্ব দেব না, তা নির্ভর করে আমি কী জানতে চাই বা জানাতে চাই তার উপর।

প শ্চিমবঙ্গ সরকার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সংক্রান্ত ৬৪টি গোপন পুলিশ-ফাইল প্রকাশ্যে এনে প্রায় আলোড়ন ফেলে দিয়েছে, এমনটাই মনে করা হচ্ছে। অবশ্যই নেতাজির মতো দেশনায়কের বিষয়ে মানুষের স্বাভাবিক কৌতূহল থাকবেই এবং গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ হল তা চরিতার্থ করা। নেতাজি তো বটেই, কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেই অহেতুক রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা কাম্য নয়, সে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী বা মাওবাদী— যা-ই হোন না কেন। বহমান ইতিহাস চর্চায় সবার সম্পর্কেই যতটা সম্ভব ঠিক তথ্য জানার অধিকার মানুষের আছে। সবটা হয়তো কখনওই জানা যায় না।

১৯৩৮ সালে গান্ধীজীর বিরোধীতা করেন তুলে ধরেন পূর্ণস্বরাজের দাবী । জহরলাল নেহেরুর মতো নেতারা তাঁকে সমর্থন করেন। গান্ধিজীর বিরোধীতার মুখে দাঁড়িয়ে, লড়াই করেন নির্বাচিত হন কংগ্রেসের সভাপতিপদে।১৯৩৯ সালে ত্রিপুরা অধিবেশনে তিনি পুনরায়  সভাপতিপদে নির্বাচিত হন। কিন্তু অধিকাংশ কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা পদত্যাগের দাবি তোলেন, তিনি নিজে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন এবং গঠন করলেন ফরওয়ার্ড ব্লক।
ইতমধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘণ্টা বেজে গেছিল। তাঁর বক্তব্য ছিল,এই যুদ্ধের  সুযোগ ভারতীয়দের নিতে হবে । ভারতীয়রা চাইলে নিজেদের সেনাবাহিনী গড়তেই পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন,  ভারতের স্বাধীনতার লড়াইতে অংশ নিতে হবে সবাইকে, তাতে রক্ত দিতে হবে সবাইকেই।

১৯১৯ সালে রাউলাট আইন চালু হলে বিদেশে থাকা সুভাষ দেশে ফিরে আসেন । দেশে ফিরে তিনি স্বরাজপত্র নামে  এক পত্রিকার সাথে যুক্ত হন। ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ যখন কলকাতার মেয়র ,সেইসময় সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন তাঁর অধীনে কর্মরত। সেখানেই তাঁর রাজনীতিতে হাতেখড়ি ,তাঁর রাজনৈতিক গুরু ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ। তাঁর রাজনীতির জীবনে ২০ বছরের মধ্যে ১১ বার গ্রেফতার হন। ১৯৩০ সালে তাঁকে নির্বাসিত করা হয় ইউরোপে । শুধুমাত্র পিতার অন্ত্যোষ্টি ক্রিয়ার জন্য তিনি দেশে ফেরেন। মনিপুর, মান্দালয়ের মতো বহু জায়গাতে তিনি নির্বাসিত হয়েছেন।

দেশত্যাগ ও আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন গৃহবন্দী। যুদ্ধতে ভারত বৃটিশদের পক্ষে যুদ্ধে যোগ দেয়। তিনি দেশত্যাগ এর সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর দলের একজন সদস্যকে নিয়ে তিনি জার্মানির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। আফগানিস্তান ও সোভিয়েত রাশিয়া হয়ে তিনি গেলেন জার্মানি। এই পলায়ন ছিল সম্পূর্ণরূপে ছদ্মবেশে। হিটলার স্মমতি দেননি, সাহায্যের হাত বাড়াননি। ১৯৪৩ সালে তিনি জার্মানি ত্যাগ করেন। সাবমেরিনে চেপে নেতাজি পৌঁছে গেলেন  জাপান।
রাসবিহারি বসু জাপানে গড়ে তুলেছিলেন ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী তিনি ১৯৪৩ সালে তাঁর দায়িত্ব তুলে দেন  নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে। একটি নারী বাহিনী সহ এতে ছিলেন মোট ৮৫০০০ সেনা। এর দায়িত্ব ছিল একটি প্রাদেশিক সরকারের হাতে ।
এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আইন ও বিচারব্যবস্থা ছিল।  মোট ৯ টি দেশের সরকার একে স্বীকৃতি দেয়। এই বাহিনী ইংরেজদের উপর আক্রমণ করে। ভারতীয় সেনা এই বৃটিশদের উপর আক্রমণের পরও বিপুল ভাবে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দেননি।

নেতাজী অনুচ্ছেদ 

নেতাজির জীবনরহস্যের চেয়ে অধিক তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক জীবন। তাঁর আড়াই দশকের রাজনৈতিক জীবন বাঙালিকে সাত দশক আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বাঙালির কাছে গাঁধী বা নেহরু কখনও সে ভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেননি বহুলাংশে সুভাষচন্দ্রের খাতিরেই। নানা রংবেরঙের কল্পনা সাজিয়ে বাঙালি তৈরি করেছে গাঁধী-সুভাষ, নেহরু-সুভাষ দ্বৈরথের কাহিনি। সেই সত্য-মিথ্যার আশ্চর্য বপনে বাঙালি মধ্যবিত্তের ড্রয়িং রুম আলোড়িত হয়েছে। গাঁধী বলেছেন, ‘সীতারামাইয়ার পরাজয় আমার পরাজয়’— এই আপ্তবাক্য শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। যদিও কথাটা ভুল। গাঁধী প্রকৃতপক্ষে আরও তীব্র অভিব্যক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। গাঁধীর মতে, সীতারামাইয়ার পরাজয় যতটা না সীতারামাইয়ার, তার থেকেও অনেক বেশি তাঁর। বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষকের কাছে শুনেছি, ১৯৩৯-৪০ কালপর্বে যখন গাঁধী-সুভাষ সম্পর্ক তলানিতে, রবীন্দ্রনাথ মধ্যস্থতার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। গাঁধী এক লাইনের টেলিগ্রাম পাঠান— ‘Tell Subhas to submit to discipline’. শোনা কথা। এ নথি সংরক্ষিত আছে কি না জানি না। সে সময়ে কংগ্রেস দলে নিয়ম ছিল, জরুরি অবস্থা ব্যতিরেকে এক ব্যক্তি পর পর দু’বছর সভাপতি হবেন না। আজকের প্রেক্ষিতে ওই নিয়ম কিছুটা অদ্ভুত শোনায় ঠিকই। তবে নেতাজি দ্বিতীয় বার সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় গাঁধী অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েছিলেন, এ কথা ধোপে টেকে না। বস্তুত তিনি দলীয় শৃঙ্খলার ওপর জোর দিয়েছিলেন, ওয়ার্কিং কমিটি থেকে সবাইকে পদত্যাগ করতে বলেছিলেন। সুভাষচন্দ্রকে অনুরোধ করেছিলেন নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে নতুন ওয়ার্কিং কমিটি তৈরি করতে। বাঙালি এ বিষয়ে চর্চা করে না যে, ওই ওয়ার্কিং কমিটি থেকে এক জন বাদে সবাই পদত্যাগ করেছিলেন। গাঁধীর নির্দেশ অমান্য করেছিলেন জওহরলাল নেহরু। নির্বাচিত সভাপতির পাশে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন, বন্ধুর মতোই তাঁর সঙ্গে বিতর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেই ইতিহাস আমরা জানতে চাই না। আমাদের রক্তে তর্ক নেই, আছে হৃদয়হীন কলহ করার অভ্যাস। তাই, বিমান দুর্ঘটনার খবর আসার পর গাঁধী যখন বলেন ‘he was a son to me’, আমরা তা মনে রাখতে চাই না।

আসলে সুভাষচন্দ্রের জীবনরহস্য উদ্ঘাটন তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নির্মোহ চর্চার চাইতে বেশি উপাদেয়। রাজনীতি চর্চা নেতাজি বনাম গাঁধীজি মার্কা একটা মোটাদাগের বিষয়ে আবদ্ধ করে নিজেদের দলীয় সুবিধালাভই আমাদের অভীপ্সা। সুভাষচন্দ্রের জীবনরহস্য জানা জরুরি। যত নথি আছে, সব সামনে আনা দরকার। প্রয়োজন তা পাঠের পর্যাপ্ত শিক্ষা। যথেষ্ট যোগ্যতার সঙ্গে এই কাজ না করলে, পুনরায় জীবনরহস্য অন্য দিকে বাঁক নিতে পারে। এ বিষয়ে কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদ নয়, প্রকৃত বস্তুনিষ্ঠ সমন্বয় প্রয়োজন।

বহু রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা এসেছে। এই বিপ্লবীদের দলে আগুন ঝরানো একটা নাম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ১৮৯৭ সালের ২৩ শে জানুয়ারী উড়িষ্যার কটক শহরে জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর সন্তান সুভাষ জন্মগ্রহণ করেন। কটকে ছোটবেলার লেখাপড়া শেষ করে তিনি র‍্যাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন । সেখানকার লেখাপড়া শেষ করে তিনি আসেন কলকাতাতে।১৯১১ সালে কলকাতা থেকে ম্যাট্রিকে প্রথম হন। ১৯১৮ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে তিনি দর্শনে বি.এ পাশ করেন। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাতে ভালো ফল করেও সে চাকরী করেননি।স্কুলে পড়াকালীন মাস্টারমশাই এর থেকে তিনি চিত্তরঞ্জন দাশের সম্পর্কে  জানতে পারেন।১৯২৪ সালে যখন চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতার মেয়র তখন তিনি তাঁর অধীনে কাজ করতেন। তাঁর ২০ বছরের রাজনীতির জীবনে তিনি মোট ১১ বার গ্রেফতার হন। মনিপুর, মান্দালয়ে ইত্যাদি জায়গায় তিনি,বহু বার থেকেছেন নির্বাসিত। ১৯৩৮ সালে গান্ধীজীর তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাঁর দাবী ছিল পূর্ণ স্বরাজের । নেহেরুর মতো নেতারা  পাশে দাঁড়ান নেতাজীর। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরা অধিবেশনে তিনি আবার কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। দলের মধ্যেকার ক্রমাগত চাপে তিনি পদত্যাগ করেন, গঠন করেন ফরওয়ার্ড ব্লক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বৃটিশদের ওপর আক্রমণ তীব্রতর করার ডাক দেন। এইসময় একদিন রাতে নিজের বাড়ি থেকে ছদ্মবেশে এদেশ ছেড়ে যাত্রা করলেন জার্মানির উদ্দেশ্যে। আফগানিস্তান , সোভিয়েত রাশিয়া হয়ে গেলেন জার্মানি। সেখান থেকে সাবমেরিনে জাপান চললেন  নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু। ১৯৪৩ সালে জাপানে রাসবিহারী বসুর প্রতিষ্ঠা করা আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্ব নেন। মোট ৮৫০০০জনের সৈন্যবাহিনী তে নারীরা ছিল সামনের সারিতে। এই বাহিনী ইংরেজদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।ভারতীয় সেনাবাহিনী বিপুলভাবে যোগ দেয়নি এই জেহাদে।তবে এই সময় তিনি বলেন সেই বিখ্যাত উক্তি “তোমরা আমায় রক্ত দাও আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।” ১৯৪৫ সালে ১৮ আগস্ট তাইহকু যাবার পথে প্লেন দুর্ঘটনাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন, তবে এ নিয়ে আজও রহস্য আছে। তাঁর লেখা কিছু বিখ্যাত বইয়ের মধ্যে  indian pilgrim আর india’s struggle for freedom বিখ্যাত। তাঁকে রবি ঠাকুর তাঁর “তাসের দেশ” নাটকে “দেশনায়ক “আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর কথা , তাঁর জীবন আমাদের সারা জীবন মাথা উঁচু করে লড়াইয়ের প্রেরনা দেয়।