Ganga – গঙ্গা নদী রচনা

মূল গঙ্গা নদীর উৎসস্থল ভাগীরথী ও অলকানন্দা নদীর সঙ্গমস্থল। হিন্দু সংস্কৃতিতে ভাগীরথীকেই গঙ্গার মূল প্রবাহ বলে মনে করা হয়। যদিও অলকানন্দা নদীটি দীর্ঘতর। অলকানন্দার উৎসস্থল নন্দাদেবী, ত্রিশূল ও কামেট শৃঙ্গের বরফগলা জল। ভাগীরথীর উৎস গোমুখের গঙ্গোত্রী হিমবাহ (উচ্চতা ৩,৮৯২ মি (১২,৭৬৯ ফু))।

গঙ্গার জলের উৎস অনেকগুলি ছোট নদী। এর মধ্যে ছটি দীর্ঘতম ধারা এবং গঙ্গার সঙ্গে তাদের সঙ্গমস্থলগুলিকে হিন্দুরা পবিত্র মনে করে। এই ছটি ধারা হল অলকানন্দা, ধৌলীগঙ্গা, নন্দাকিনী, পিণ্ডার, মন্দাকিনী ও ভাগীরথী। পঞ্চপ্রয়াগ নামে পরিচিত পাঁচটি সঙ্গমস্থলই অলকানন্দার উপর অবস্থিত। এগুলি হল বিষ্ণুপ্রয়াগ (যেখানে ধৌলীগঙ্গা অলকানন্দার সঙ্গে মিশেছে), নন্দপ্রয়াগ(যেখানে নন্দাকিনী মিশেছে), কর্ণপ্রয়াগ (যেখানে পিণ্ডার মিশেছে), রুদ্রপ্রয়াগ (যেখানে মন্দাকিনী মিশেছে) এবং সবশেষে দেবপ্রয়াগ যেখানে ভাগীরথী ও অলকানন্দার মিলনের ফলে মূল গঙ্গা নদীর জন্ম হয়েছে।

হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে গঙ্গার দৈর্ঘ্য্য ২৫০ কিলোমিটার (১৬০ মা)।হৃষিকেশের কাছে গঙ্গা হিমালয় ত্যাগ করে তীর্থশহর হরিদ্বারে গাঙ্গেয় সমভূমিতে পড়েছে। হরিদ্বারে একটি বাঁধ গড়ে গঙ্গা খালের মাধ্যমে গঙ্গার জল উত্তরপ্রদেশের দোয়াব অঞ্চলে জলসেচের জন্য পাঠানো হয়ে থাকে। এদিকে গঙ্গার মূলধারাটি হরিদ্বারের আগে সামান্য দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী হলেও হরিদ্বার পেরিয়ে তা দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে।

জন্ম 

গঙ্গার জন্মকাহিনি বিষয়ে হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলির মধ্যে মতদ্বৈধ দৃষ্ট হয়। একটি কাহিনি অনুযায়ী ব্রহ্মার কমণ্ডলু এক নারীমূর্তির স্বরূপ প্রাপ্ত হয়। ইনিই গঙ্গা। বৈষ্ণব মতানুসারে, ব্রহ্মা তাঁর কমণ্ডলুর জল নিয়ে সশ্রদ্ধ চিত্তে বিষ্ণুর পদ ধৌত করেছিলেন। সেই থেকেই গঙ্গার জন্ম। তৃতীয় একটি মত অনুযায়ী, গঙ্গা পর্বতরাজ হিমালয় ও তাঁর পত্নী মেনকার কন্যা এবং পার্বতীর ভগিনী। তবে প্রতিটি মতেই একথা স্বীকৃত যে ব্রহ্মা গঙ্গাকে পবিত্র করে তাঁকে স্বর্গে উত্তীর্ণ করেন।

গঙ্গানদী সম্পর্কিত কিছু কথা 

গঙ্গা নদী (Ganges River)  ভারত ও বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ  নদী। এটি পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা বৃহৎ নদীপ্রণালী সমূহের মধ্যে অন্যতম। এর ইংরেজি উচ্চারণ ‘গ্যানজেস’ সংস্কৃত নাম ‘গঙ্গা’-এর অপভ্রংশ, যা একজন গ্রিক ইতিহাসবেত্তা কর্তৃক প্রথম ব্যবহূত হয়েছিল। সমগ্র ভারতবর্ষ এবং যে সকল স্থানে ভারতীয় সভ্যতার বিস্তৃতি ঘটেছিল সে সব অঞ্চলে গঙ্গা নামটি সুপরিচিত। এর নিষ্কাশন অববাহিকা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের একটি এবং এ অঞ্চলেই ইন্দো-আর্য সভ্যতা বহু শতাব্দী ধরে বিকশিত হয়েছে। গঙ্গা ছাড়াও এ নদীপ্রণালী অনেক গুরুত্বপূর্ণ শাখা নদীসমূহকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে যমুনা, কালী, কার্ণালি, রামগঙ্গা, গন্ডক এবং কোশি। এসবের সবকটিই  হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎসারিত এবং প্রধানত গলিত বরফ থেকে এদের সৃষ্টি। মূলত গঙ্গা দুটি উপনদী থেকে সৃষ্ট- ভাগীরথী এবং অলকানন্দা।

তিববত-ভারতের সীমান্তের সন্নিকটে গঙ্গা নদীর উৎপত্তি। প্রচলিতভাবে ভাগীরথীকে মূল গঙ্গা হিসেবে মেনে নেওয়া হয় যদিও অলকানন্দা তুলনামূলকভাবে বৃহত্তর নদী। গঙ্গার মূল উৎস হিমালয় পর্বতমালার প্রায় ৩,৯০০ মিটার উচ্চে অবস্থিত গঙ্গোত্রী হিমবাহ। গঙ্গোত্রী তীর্থস্থানটি গোমুখ থেকে কয়েক কিলোমিটার ভাটিতে। ভাগীরথী নদী গঙ্গার পশ্চিমদিকের উপনদী জাহ্নবীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে মূল হিমালয় থেকে সামান্য উত্তরে এবং এ স্থানটি গঙ্গোত্রী মন্দির থেকে প্রায় ১১ কিমি নিচে। নদীর সম্মিলিত ধারাটি এর পরে হিমালয় অঞ্চল ভেদ করে একটি বিশাল গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ গিরিসঙ্কটে নদীর তলদেশ উভয় পার্শ্বের পর্বতচূড়া থেকে প্রায় ৩,৯৬০ মিটার নিচে।

নদীটি দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখে ভারতভূমিকে অতিক্রম কওে প্রবাহিত বাংলাদেশের পশ্চিম সীমান্তে  নবাবগঞ্জ জেলার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভূখন্ডে প্রবেশ করেছে। দেশের অভ্যন্তরেও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে এটি গোয়ালন্দঘাটের কাছে যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়ে আরও ভাটিতে চাঁদপুরের কাছে মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। যমুনার সঙ্গে সঙ্গমস্থল থেকে মেঘনা সঙ্গম পর্যন্ত নদীটির নাম  পদ্মা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গঙ্গা নদীর সমগ্র প্রবাহপথই ‘পদ্মা’ নামে বহুল পরিচিত, যদিও তা সঠিক নয়। যমুনা সঙ্গম পর্যন্ত গঙ্গার সর্বমোট দৈর্ঘ্য ২,৬০০ কিমি এবং এর নিষ্কাশন অঞ্চলের আয়তন ১০,৮৭,৪০০ বর্গ কিমি যার মাত্র ৪৬,৩০০ বর্গ কিমি এলাকা বাংলাদেশ ভূখন্ডের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে এর উপনদী কেবল একটি  মহানন্দা, যেখানে শাখানদী রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যেমন: ইছামতি, নবগঙ্গা, ভৈরব, কুমার, গড়াই-মধুমতি এবং আড়িয়াল খাঁ।

গঙ্গা একটি গুরুত্বপূর্ণ জলশক্তি প্রণালী যা পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপগুলির একটিকে গঠন করেছে। এ বদ্বীপভূমির আওতাভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের অধিকাংশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি বৃহত্তর অংশ। গাঙ্গেয় বদ্বীপভূমির উন্নয়নের দীর্ঘ ইতিহাসে দেখা যায়, নদীটি পূর্বের প্রবাহপথ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে সরে এসে বঙ্গের নিম্নভূমির বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছে। গঙ্গা এবং তার উপনদী এবং শাখানদী এ বদ্বীপভূমির উন্নয়নে সুদীর্ঘ সময় জুড়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। গঙ্গা-যমুনা-মেঘনা প্রণালীর বদ্বীপ মোহনার নদীগুলির সম্মিলিত নিষ্কাশিত পানি অপসারণের পরিমাণ গড়ে ৩৫,০০০ কিউসেক। গঙ্গার বর্ষা মৌসুমে পানি অপসারণের পরিমাণ ৭৬,০০০ কিউসেক পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং সে সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে  পলি বাহিত হয়ে থাকে। শুষ্ক মৌসুমে নদীর প্রবাহ প্রায় ১৫,০০০ কিউসেক এবং স্বাভাবিকভাবেই এ সময়ে পলি বহনের পরিমাণ খুবই সামান্য হয়ে থাকে।  বদ্বীপ অংশে নদীর প্রশস্ততার পরিসীমা ১.৬ থেকে ৮ কিমি এবং কখনো কখনো এখানে কিছুটা বিনুনী প্রবাহের বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় যদিও এটি একটি সর্পিল প্রকৃতির নদী। গঙ্গার বদ্বীপভূমির শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক শহর গৌড় এর নিকট থেকে। নদীর বর্তমান প্রধান শাখাটি দক্ষিণ-পূর্বাভিমুখে প্রবাহিত ও বাংলাদেশ ভূখন্ডে এ প্রবাহ পদ্মা নামে বহুল পরিচিত। কয়েক শতাব্দী পূর্বে বঙ্গ সমভূমিতে গঙ্গার প্রধান নদীখাত ছিল হুগলি। ভাগীরথী, জালাঙ্গী এবং মাথাভাঙ্গা শাখা নদীসমূহের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে এদের নদীয়া নদী বলা হতো। উল্লেখ্য যে, গঙ্গা নদীতে ভারতের নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ বাংলাদেশের পরিবেশের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে চলেছে।

গঙ্গার জলচক্র দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমী বায়ু-ঘটিত বর্ষাকালের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বর্ষার ৮৪% শতাংশ বৃষ্টিপাত হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে। পাশাপাশি গঙ্গার নিজস্ব জলপ্রবাহও ঋতুনির্ভর। হার্ডিঞ্জ ব্রিজের পরিমাপ অনুযায়ী, শুখা মরসুম ও বর্ষাকালের জলপ্রবাহের অনুপাত ১:৬। এই ঋতুনির্ভর জলপ্রবাহ এই অঞ্চলে ভূমি ও জলসম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত নানা সমস্যার জন্মদাতা। এর ফলে খরা ও বন্যা দুইই দেখা যায়। বিশেষ করে বাংলাদেশে, শুখা মরসুমে খরা ও বর্ষাকালে বন্যা একটি প্রধান সমস্যা।

গাঙ্গেয় বদ্বীপে অনেক বড় নদী রয়েছে। এগুলি হয় উপনদী নয় শাখানদী। এই সব নদনদী একটি জটিল নদীজালিকা সৃষ্টি করে রেখেছে। গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র এদের মধ্যে বৃহত্তম নদী। দুই নদীই একাধিক শাখানদীতে বিভক্ত হয়েছে, আবার শাখানদীগুলিও পরস্পর মিলিত হয়েছে। তবে এই নদীজালিকাগুলিতেও মাঝে মাঝে ভৌগোলিক পরিবর্তন দেখা যায়।

দ্বাদশ শতাব্দীর আগে ভাগীরথী-হুগলি শাখানদীটিই ছিল গঙ্গার মূল প্রবাহ। পদ্মা ছিল একটি ছোট শাখানদী মাত্র। তবে গঙ্গা বঙ্গোপসাগরে মিলিত হত আধুনিক হুগলি নদীর পথে নয়, মাধ্যমে। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভাগীরথী-হুগলি ও পদ্মার আকার প্রায় একই হয়ে দাঁড়ায়। ষোড়শ শতাব্দীর পরে পদ্মা আকার বৃদ্ধি পায় এবং তা গঙ্গার মূল প্রবাহপথে পরিণত হয়। মনে করা হয়, ভাগীরথী-হুগলির প্রবাহপথটি ক্রমে ক্রমে পলি পড়ে রুদ্ধ হয়ে যায়। সেই জন্যই গঙ্গার মূল প্রবাহ পদ্মার পথে সরে গিয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দী শেষাশেষি পদ্মাই গঙ্গার মূল প্রবাহপথ হয়ে দাঁড়ায়।গঙ্গার মূল প্রবাহপথ পদ্মায় সরে যাওয়ার ফলে ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর পৃথকভাবে বঙ্গোপসাগরে না মিশে একসঙ্গে মিলিত হয়। গঙ্গা ও মেঘনার বর্তমান সঙ্গমস্থলটি দেড়শো বছর আগে গঠিত হয়েছে।

আঠারো শতকের শেষাশেষি নিম্ন ব্রহ্মপুত্রেরও প্রবাহপথে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছিল, যার ফলে গঙ্গার সঙ্গে এর সম্পর্কটিই যায় বদলে। ১৭৮৭ সালের বিধ্বংসী বন্যা তিস্তা নদীর প্রবাহপথটি ঘুরে যায়। এই নদী আগে গঙ্গা-পদ্মার উপনদী ছিল। ১৭৮৭ সালের বন্যার পর নদীটি গতিপথ পালটে পূর্বদিকে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রে পড়ে। ফলে ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ দক্ষিণে সরে আসে এবং একটি নতুন নদীপথের সৃষ্টি হয়। ব্রহ্মপুত্রের এই নতুন প্রধান গতিপথটির নাম হয় যমুনা নদী। এটি দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে গঙ্গা-পদ্মায় মিলিত হয়। আগে ব্রহ্মপুত্রের গতি ছিল কিঞ্চিৎ পূর্বমুখী। তা ময়মনসিংহ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীতে মিশত। বর্তমানে এই নদীপথটি একটি ছোট শাখানদী হলেও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে ব্রহ্মপুত্র নামটি বজায় রেখেছে। লাঙ্গলবাঁধে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সঙ্গমস্থল হিন্দুদের কাছে আজও পবিত্র। এই সঙ্গমের কাছেই ঐতিহাসিক উয়াড়ি-বটেশ্বর অবস্থিত।

শেষ কথা 

গঙ্গানদী যে কেবল সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় তাৎপর্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ তাই নয়, দেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি এর ওপর নির্ভরশীল। ২০১৪ সালে নিউইয়র্কে ম্যাডিসন স্কোয়ার পার্কে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের উদ্দেশে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “যদি এই নদীকে আমরা পরিচ্ছন্ন করে তুলতে পারি, তা হলে দেশের ৪০ শতাংশ মানুষের বিরাট উপকার হবে। তাই, গঙ্গাকে পরিষ্কার করার জন্য ভারত সরকার নমামী গঙ্গে(Namami Gange) নামে এক উদ্যোগ নিয়েছেন সেই কাজ টি একধরণের অর্থনৈতিক কর্মসূচিও বটে”।

“গঙ্গা আমাদের ঐতিহ্য,গঙ্গা আমাদের শান ,

গঙ্গা আমাদের মাতৃ বক্ষ, গঙ্গা আমাদের প্রাণ”
আমরা কি পারিনা একটু সবাই মিলে আমাদের মা গঙ্গা নদীটাকে একটু নিজেদের মতো করে আপন মায়ের মতন একটু রক্ষা করি। আসুন আমাদের সভ্যতার প্রতীক, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ, জাতীয় নদী গঙ্গাকে বাঁচাতে সকলে হাতে হাত মেলাই।