লজ্জাবতী – Mimosa Trees in Bengali

লজ্জাবতী হলো প্রায় ৪০০ প্রজাতির গুল্ম ও লতার একটি গণের নাম, যা লেগিউম জাতীয় ফ্যাবায়েসি পরিবারের  Mimosoideae উপ-পরিবারের অন্তর্গত। এর পাতা ছোঁয়া মাত্র বন্ধ হয়ে যায়। তাপের প্রভাবে, বা সন্ধ্যা বেলাতেও পাতা বন্ধ হয়ে যায়। মূলত সিসমোন্যাস্টিক চলন(Seismonastic Movement)-এর প্রভাবেই এর পাতা বন্ধ হয়ে যায়। থোকায় থোকায় ফুল ফোটে। এর ফলগুলো চ্যাপ্টা, বাঁকা-লম্বাটে। এর আদি নিবাস মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে, তবে বর্তমানে বিশ্বের সব জায়গায় এটি ছড়িয়ে পরেছে। এটি একটি বর্ষ জীবি আগাছা ও গুল্ম জাতীয় গাছ। এর কান্ড লতানো শাখা প্রশাখায় ভরা ও কাঁটাযুক্ত। কিছুটা লালচে রঙের। এটি সহজে ভাঙে না বরং পেঁচিয়ে টানলে চিরে যায়। এর পাতা যৌগিক পত্র। কয়েকজোড়া পাতা বিপ্রতীকভাবে থাকে। অনেকটা দেখতে তেতুল পাতার মতন। হাত ও পায়ের স্পর্শে লজ্জাবতির পাতা বুঝে এসে বন্ধ হয়ে যায়। পাতা সরু ও লম্বাটে রকমের হয়ে থাকে। আর সংখ্যায় ২ থেকে ২০ জোড়া। এর ফুল উভলিঙ্গ। বৃতির সংখ্যা ৪ টি, পাপরি ৪ টি,ফুল গুলি বেগুনি ও গোলাপি রঙের। ফল দেখতে চ্যাপ্টা এবং একত্রিত। সাধারণত মে থেকে জুন মাসে ফুল আসে। জুলাই অগাস্ট মাসে ফুল থেকে ফল হয়, এবং জানুয়ারী – ফেব্রুয়ারী মাসে ফল থেকে ছাড়া জন্মায়। 

হারানো শক্তি ফিরে পেতে লজ্জাবতী গাছ, ব্যবহার করুন 

আমাদের অতি পরিচিত একটি গাছ লজ্জাবতী আবার কেউ কেউ এক বলেন লাজুক লতা। এটি একটি বর্ষজীবি গুল্ম আগাছা বা ওষুধী গাছ। অনেকটা তেতুল পাতার মত। হাত ও পায়ের স্পর্শে লজ্জ্বাবতীর পাতা বুঁজে এসে বন্ধ হয়ে যায়। পাতা সরু ও লম্বাটে, সংখ্যায় ২ থেকে ২০ জোড়া। এর ফুলগুলি বেগুনী ও গোলাপী রঙের। এর পাতায় এ্যাকোলয়ড়ে ও এড্রেনালিন এর সব উপকরণ থাকে। এছাড়াও টিউগুরিনস এবং মুলে ট্যানিন থাকে। যা পুরুষাঙ্গের শিথীলতা দূর করা সহ আরো নানাবিধ রোগ সারাতে ব্যবহার হয়। লজ্জাবতী লতার সমগ্র উদ্ভিদ ঔষধ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এর ঔষধি গুণগুলি ধারাবাহিক ভাবে তা আলোচনা করা হলো।

দাঁতের মাড়ির ক্ষত

দাঁতের মাড়ির ক্ষত সারাতে গাছ সহ ১৫ থেকে ২০ সে.মি. লম্বা মূল পানিতে সিদ্ধ করে সে পানি দিয়ে ৭ দিন দিনে ৩ বার কুলকুচা করলে ভালো হয়।

পুরুষাঙ্গের শৈথিল্য

লজ্জাবতীর বীজ দিয়ে তৈরি তেল লাগিয়ে আস্তে আস্তে মালিশ করলে তা পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হয়। স্বাভাবিক উত্তেজনা ফিরে আসে।

স্ত্রী যৌনাঙ্গের ক্ষত সারাতে

যে কোন কারনে যনিপথে ক্ষত হলে, প্রথমিক স্তরে মাঝে মাঝে অথবা প্রায় রোজই অল্প স্রাব চলতে থাকে, একটা আশটে গন্ধ, কখনো বা একটু লালচে স্রাব হয়, এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসক সাবধান করে থাকেন, এটি পরিণামে ক্যান্সার হয়ে যেতে পারে। এক্ষেত্রে দুধ জলে সিদ্ধ করা লজ্জাবতীর নির্জাস দিনে ২ বার খেলে এ রোগ উপশম হয়। একই সাথে লজ্জাবতীর নির্জাস দিয়ে ডুশ দিলে বা যোনিপথ ধুলে তাড়াতাড়ি ক্ষত সেরে যায়।

আঁধার যোনি ক্ষত

এ বিচিত্র রোগটি কৃষ্ণপক্ষে বেড়ে যায় আর শুক্লপক্ষে শুকাতে থাকে। এ ক্ষতটি হয় সাধারণত হাটুর নিচে আর না হয় কুঁচকির দু’ধারে। এক্ষেত্রে গাছও পাতা ( মূল বাদে ) ১০ গ্রাম শুধু জল দিয়ে নির্জাস করে খেতে হয় এবং ঐ নির্জাস দিয়ে মুছতে হয়।

রমনে অতৃপ্তি

কয়েকটি সন্তান হওয়ার পর যোনিদ্বার অনেকটা শিথিল হয়ে যায়, এক্ষেত্রে লজ্জাবতীর নির্জাস দিয়ে ডুশ নেওয়ায়, আর গাছের পাতা সিদ্ধ নির্জাস দিয়ে তৈরি তেলে ন্যাকড়া ভিজিয়ে যোনিদ্বারে দিয়ে রাখলে (Vaginal plugging) ভাল ফল পাওয়া যায়। এছাড়া অন্ডকোষের পানি জমা সারাতে পাতার পেস্ট ব্যবহার করা হয়।

আমাশয়

অনেকের আছে পুরানো আমাশয়। মল ত্যাগের বেগ হলে আর অপেক্ষা করতে পারে না। আবার অনেকের শক্ত মলের গায়ে সাদা সাদা আম জড়ানো থাকে। এক্ষেত্রে ১০ গ্রাম লজ্জাবতীর ডাঁটা ও পাতা ৪ কাপ পানিতে সিদ্ধ করে ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ছেঁকে নিতে হবে। এ নির্জাস খেলে তারা অবশ্যই উপকার পাবেন।

ঘামের দুর্গন্ধ দুর করতে

অনেকের ঘামে দুর্গন্ধ হয় এবং জামায় বা গেঞ্জিতে হলদে দাগ লাগে, এক্ষেত্রে লজ্জাবতী গাছের ডাঁটা ও পাতার নির্জাস তৈরি করে বগল ও শরীর মুছতে হবে বা লাগাতে হবে। তাহলে এ দুর্গন্ধ দুর হবে।

কোষ্ঠকাঠিন্য

এক্ষেত্রে মূল ৭/৮ গ্রাম থেঁতো করে সিদ্ধ করতে হবে এবং ছেঁকে ঐ পানিটা খেতে হবে। তাহলে উপকার হবে। সাদা ফুলের লজ্জ্বাবতীর পাতা ও মুল পিষে রস বের করে নিয়মিত খেলে পাইলস্ ও ফিস্টুলায় আরাম পাওয়া যায়। 

লজ্জাবতীর পাতার কিছু গুনাগুন 

  • গুনাগুন – অর্শ রোগে লজ্জাবতীর মূল সহ ১০ গ্রাম নিয়ে এতে ১ কাপ দুধ ও ৩ কাপ জল মিশিয়ে সেদ্ধ করুন অবশিষ্ট ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ফেলুন ও মিশ্রণ টি ২ ভাগ কইরে সকালে ও রাত্রে পান করুন। দেখবেন ১৫ দিনে অর্শ সেরে যাবে।
  • পুরাতন আমাশয় – লজ্জাবতীর পাতা ও ডাটা ১০/১২ গ্রাম নিয়ে ৪ কাপ জল দিয়ে সেদ্ধ করুন ও অবশিষ্ট ১ কাপ থাকতে নামিয়ে ফেলুন। তারপর ২ ভাগ করে সকালে এবং রাতে ঠিক থাকে মতিন পান করুন ১০ দিন, দেখবেন ঠিক ১০ দিন এর মধ্যেই আমাশয় সেরে যাবে।
  • কানে পুঁজ হলে – লজ্জাবতীর কাথ তৈরী করুন ও সাথে সরষের তেল মিশিয়ে কানে ১ ফোটা করে ব্যাবহার করুন।  পুঁজ সেরে যাবে।
  • যৌন শক্তি বৃদ্ধিতে – লজ্জাবতীর বীজ দিয়ে তেল তৈরী করে বা বানিয়ে ব্যবহার করলে যৌনাঙ্গ দৃঢ় ও শক্ত হয়।
  • যৌনাঙ্গ শৈথিল্যে – মহিলাদের অধিক সন্তান প্রসবের ফলে যৌনাঙ্গ শিথিল হয়ে যায়। লজ্জাবতীর গাছ, পাতা, ও শিকড় দ্বারা তেল বানিয়ে কাপড় এ মেখে পিচু ধারণ করলে কয়েকদিনের মধ্যেই আরোগ্য হয়ে থাকে।

ছোঁয়া লাগলে লজ্জাবতী গাছের পাতা নুয়ে পড়ে কেন 

ছোঁয়া লাগলে লজ্জাবতী গাছের পাতা নুয়ে পড়ে কেন এই পরীক্ষা করে জগদীশ চন্দ্র বসু দেখিয়েছিলেন যে, মানুষের মতো গাছেরও অনুভূতি আছে। লজ্জাবতীর ছোট ছোট পত্রগুলো আলো পেলে খুলে যায়, অন্ধকারে বন্ধ হয়, কিন্তু হঠাৎ ছুঁলে পাতা নুয়ে পড়ে এবং ছোট পত্রগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। লজ্জাবতীর পাতা কেন নুয়ে পড়ে, এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা অনেক কিছুই জানতে পেরেছেন। লজ্জাবতী পাতার গোড়া একটু ফোলা থাকে। এর ভেতরে বড় বড় অনেক কোষ আছে। ওইসব কোষ যখন জলভর্তি হয়ে ফুলে ওঠে তখন লজ্জাবতী পাতার ডাঁটাটি সোজা হয়। কিন্তু হঠাৎ পাতা ছুঁলে ওই ফোলা কোষগুলো থেকে জল বাইরে বেরিয়ে পেছন দিককার কোষে চলে যায়। ফলে কোষগুলো চুপসে পড়ে। চুপসানো কোষে জলের চাপ কম থাকে। তাই লজ্জাবতী পাতার ডাঁটাটিও আর সোজা থাকতে পারে না, নিচের দিকে নুয়ে পড়ে। যে পাতাটিকে ছোঁয়া হয়, এ ব্যাপারটা শুধু যে তার মধ্যেই নজরে আসে এমন নয়। আস্তে আস্তে তা উপর-নিচে সব পাতায়ই ছড়িয়ে যায় এবং এভাবে সব পাতাই নুয়ে পড়ে। শুধু পাতাগুলোই নুয়ে পড়ে না, পাতার ছোট ছোট পত্রগুলোও জোড়া লেগে বন্ধ হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, লজ্জাবতীর পাতা স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা তড়িৎ প্রবাহ গাছের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ‘অ্যাসিটাইল কেলিন’ জাতীয় এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে এই তড়িৎ প্রবাহিত হয়। এই রাসায়নিক পদার্থ খুবই দ্রুত এক কোষ থেকে আরেক কোষে যেতে পারে।

শেষ কথা 

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এমন অনেক কিছুই আছে যেটা আমাদের জানা নেই। আমাদের বাড়ির আনাচে কানাচে এমন অনেক জিনিস থাকে যা দিয়ে আমাদের অনেক অসুখ সেরে যায় যা আমাদের অজানা। আমাদের এই লেখাটা ভালো করে পড়লেই আপনি বুঝতে পারবেন যে আমাদের অতি পরিচিতি লজ্জাবতী গাছ বা ছাড়া বা পাতা দিয়ে আমাদের কি কি কাজে লাগে। ভালো থাকবেন ধন্যবাদ।

লেখক – শান্তনু পাল