স্কুল বিদায়ের কবিতা – Quotes on School in Bengali

স্কুল শব্দ টা শুনলেই যেন মনের ভিতর স্মৃতির পাহাড় জমে ওঠে। বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে ওঠে একরাশ কান্না।  আবার পরক্ষনেই ঘুরপাক খায় আনন্দঘন মুহুর্তরা। আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই ভালো মন্দ সময় আসে। কালের নিয়মে যা আমরা ভুলেও যাই, বা ভুলতে চাই। কিন্তু স্কুল জীবন প্রত্যেকের কাছেই বিশেষ অর্থ বহন করে। এই স্মৃতি কেই পাথেয় করে আমরা পরবর্তী জীবনের পথ হেঁটে যেতে পারি। এই জীবনের সাথে মায়ের নামটি অদ্ভুত ভাবে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। মায়ের বানানো  টিফিন সবার সাথে ভাগ করে খাওয়া, মায়ের চুল বেঁধে দেওয়া, ক্লাস নাইন এ প্রথম পরিপাটি করে শাড়ি পরিয়ে দেওয়া, প্রেমে আঘাত পেয়ে প্রথম মা কে জড়িয়ে কাঁদা। মায়ের পরিয়ে দেওয়া হাফ প্যান্ট তা ছোট হয়ে আসা। খেলতে গিয়ে পড়ে হাটু ছোড়ে দৌড়ে মায়ের কাছে এসে কান্না। মার্ আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছিয়ে দেওয়া। পড়া না পেরে মাস্টারমশাইয়ের কানমলা খাওয়া অথবা পড়া পেরে আশীর্বাদের হাতটি মাথায় নেওয়া। স্কুলের সাথে আরেকটি শব্দ ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তা হলো বন্ধুত্ব। বন্ধু মানেই মন খারাপের সঙ্গী। বন্ধু মানে খুব সহজেই বলা আজ আড়ি তোর সাথে। বয়ঃসন্ধিতে সিগারেট ভাগ করে খাওয়ার নাম বন্ধুত্ব। এসবই স্কুল জীবনে ঘটে যাওয়া টুকরো টুকরো ঘটনা।

স্কুল পালিয়ে সিনেমা দেখা, স্কুলের বাইরে ফুচকা খাওয়া, স্যার কে দেখে সিগারেট পিছনে করে ফেলা, প্রথম প্রেম পত্র পাওয়া, দেওয়া।কিছুই ভোলার নয়। আজ ও স্কুল টার পাশ দিয়ে গেলে শোনা যায় গুনগুনিয়ে নামতা পড়া, মনে হয় ছুটির ঘন্টা টা বুঝি ওই বেজে উঠলো। মনে হয় এক্ষুনি এক ঝাঁক ছাত্র ছাত্রীর দল পিঠে ব্যাগের বোঝা নিয়ে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে আসবে।

মন দিয়ে পড়াশোনা।

এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই– নামতা পড়ে ছেলেরা সব পাঠশালার ওই ঘরে; নন্দি বাড়ির আটচালাতে কুমর ঠাকুর গড়ে । মন বসে কি আর ?

সেই ছোট্ট বেলা থেকে মা বলতেন জোরে জোরে পড় মুখস্থ হবে। সত্যিই হত। সহজ পাঠের পদ্য, গদ্য, নামতা, বাংলা ব্যকরণে সমাস, সন্ধি আরও কত কি। আরও বড় হতে থাকার পর ইতিহাস,ভূগোল, বিজ্ঞান সব দুলে দুলে পড়া আর মুখস্থ করা। যে যতই উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হোক না কেন স্কুল জীবন এর এই নিয়ম করে বাঁধা ছকে পড়াশোনা র কথা ভোলা কারুর পক্ষে সম্ভব নয়।

ছুটির আনন্দ এ মাতোয়ারা মন।

বাজল ছুটির ঘন্টা এ হে মন ভেসে ভেসে উড়ে যায় নিরুদ্দেশে বাদলে মাদল বাজে তা ধিন ধিন তা ধিন তা।

এখন যখন অফিস থেকে ছুটি হয়, অথবা  সারাদিন তেতে পুড়ে রান্না ঘর থেকে একটু বিশ্রাম,একটু ছুটি তখন মনে হয় কলুর বলদের মতো টেনে নিয়ে যাওয়া জীবনের থেকে একটা দিন ছুটি হল।সত্যি ই কি সে ছুটি আসলে ছুটি? না ছুটি নামে কোনো প্রহসন? এই ছুটি ছিল পরের দিনের ছোটাছুটির এক প্রস্তুতি। আসল ছুটি ছিল সেদিন যেদিন ছুটির ঘন্টা বাজার আগের শেষ ১৫ মিনিট পড়ায় মন বসত না। মনে হতো মা, বাবা বা দাদু দাঁড়িয়ে আছেন গেটের বাইরে হয়তো  আমার বায়না মেটাতে, ঝালমুড়ি, ফুচকা, আইসক্রিম এর বায়না। ও ছুটি ছিল সত্যি আনন্দের। অনাবিল আনন্দ।যাকে শুধু কয়েকটি শব্দে বেঁধে প্রকাশ করা মুশকিল।

মাস্টারমশাই এর  বকুনি, আদর, ভালোবাসা।

বর্ষে বর্ষে দলে দলে আসে বিদ্যামঠ তলে, চলে যায় তারা কলরবে, কৈশোরের কিশলয় পর্ণে পরিণতি হয় যৌবনের শ্যামল গৌরবে।

অভিভাবক হিসেবে বাবা, মার পর শিক্ষক শিক্ষিকার স্থান। একথা অনস্বীকার্য। তাদের জীবনে ও ছাত্ররা সন্তান তুল্য। আদর করে পিঠ চাপড়ে  পাশে বসিয়ে পড়ানো। আবার না পারলে সেই পিঠ চাপকে লাল। সন্তান স্নেহে পালন করত প্রত্যেক টা ছাত্র কে।অর্থ অভাবে পড়তে না পারলে এর স্নেহে র হাতে তুলে দিতেন খাতা, বই, পেন, পেন্সিল ।

চল, আজ থেকে আমরা বন্ধু ।

যদি বন্ধু হও যদি বাড়াও হাত জেনো থামবে ঝড় মুছে যাবে এই রাত হাসি মুখ তুলে অভিমান ভুলে রাঙা সূর্য বলবেই সুপ্রভাত 

 স্কুল জীবন এর একটি বড় পাওয়া হল বন্ধু।কখনো পাশে বসে মায়ের টিফিন ভাগ করে খাওয়া আবার কখনো ঝগড়া করে দূরে সরে গিয়ে একলা বসে কান্নাকাটি করা। পরের দিন দেখা করে সব ঝগড়া মিটিয়ে নেওয়া। প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার করা। প্রেমে কষ্ট পেয়েও বন্ধুকেই জড়িয়ে ধরা। বন্ধু মানে সে পড়া না পেরে শাস্তি পেলে  আরেক জনের ও জানা পড়াটা বলতে উঠে না বলা।

আকাশের ঘন নীলে সবুজ ঘাসে ঘাসে বন্ধুত্ব।

ডাকছে আকাশ, ডাকছে বাতাস, ডাকছে মাঠের সবুজ ঘাস, ও ছেলেরা খেলা ফেলে শুধুই কেন পড়তে যাস !

ক্লাসে র পিছনের বেঞ্চে বসে থাকা যে ছেলে টিকে দেখে আমরা খুব সহজেই সিদ্ধান্ত নি ছেলেটি পড়াশোনায় খারাপ বা অন্যমনস্ক একবারকি ভেবে দেখেছি তার মন টা বোধ হয় সবুজ ঘাসে লুটোপুটি খাচ্ছে। নীল আকাশে র সাদা মেঘে উঁকি দিচ্ছে। জানলার রেলিঙের  ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া আকাশ মাঠ গাছপালাই তার একমাত্র জগৎ। আজ হয়তো সে কোনো ১২ তলায় অফিসের জানলা দিয়ে মাঠ আকাশ গাছপালা দেখে মনে করে সেই স্কুলের জানলা, বারান্দা, কড়িবরোগা।সব মনে করে হয়তো চোখের কোনে চিকচিক করে ভরে ওঠে জল।

স্কুল মানে প্রথম প্রেমে পড়া। 

লাল ফিতে সাদা মোজা সু স্কুলের ইউনিফর্ম ন’টার সাইরেন সংকেত সিলেবাসে মনোযোগ কম পড়া ফেলে এক ছুট ছুটে রাস্তার মোড়ে, দেখে সাইরেন মিস করা দোকানীরা দেয় ঘড়িতে দম। 

ছোট বেলায় যে বন্ধু বা বান্ধবী র সাথে একসাথে স্কুল যাওয়া  টিফিন শেয়ার করা, পড়া না করলে ধমক দেয়া, হঠাৎ করে যেন তাকে ভালোবেসে ফেলা। সরস্বতী পুজোর দিন  বাসন্তী রঙের শাড়ির আঁচলে মন আটকে যায় কিংবা হালকা গোঁফের রেখায় মন টা চঞ্চল হয়ে ওঠে। কিন্তু কারুর কারুর ক্ষেত্রে এই প্রেম সারাজীবন থেকে যায় কারুর আবার স্কুল লাইফেই তার  পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু মনের মধ্যে বেঁচে থাকে চিরকাল।

স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী

স্কুলের ব্যাগটা বড্ড ভারী আমরা কি আর বইতে পারি? এও কি একটা শাস্তি নয় ? কষ্ট হয়, কষ্ট হয় !

স্কুল ফেরত কোনো বাচ্চাকে দেখলে মনে হয় তার ছোট্ট শরীর টার থেকে ব্যাগের ওজন বেশী। সত্যি ওই ছোট ছোট শিশু গুলির উপর বড্ডো চাপ। মা বাবার ইচ্ছে পূরণের চাপ। পাশের বাড়ির বাচ্চাটির থেকে আরো ভালো পড়াশোনায় বা গানে আঁকায় তুখোড় হওয়ার চাপ। তবে দিনের শেষে কখনো কখনো মনে হয় এই বোঝা বোধ হয় অনেক ভালো জীবনের বোঝার থেকে। অফিসে, রান্নাঘরে, সেবা সুশ্রয়াই সব দিকে দায়িত্ত সামলাতে সামলাতে দিনের শেষে গাধা জাতীয় প্রাণীটির সাথে মিল পাওয়া যায়। এ বোঝা কমেতো নাই উল্টে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্রমশ বাড়তেই থাকে।

ক্লাস রুমের স্মৃতি।

ক্লাস রুমের স্মৃতি। ঘুম ঘুম ক্লাসরুম  পাশে খোলা জানলা  ডাকছে আমাকে  আমার আকাশ

ক্লাস রুমের জানলা, ব্ল্যাকবোর্ড,চক,ডাস্টার, বেঞ্চ, সব এখন স্মৃতি। ১১ টা থেকে ৪ টে গম গম করা ক্লাস রুম। কোনো ক্লাসে বাংলা তো কোনো ক্লাসে ইংরাজি  আবার কোনো ক্লাসে উপপাদ্য, পাটিগণিত, বীজগণিতের অংক শেখা। আবার ক্লাস চলাকালীন পিছনের বেঞ্চে বসে মাথাটা হাই বেঞ্চে রেখে একটু ঘুমিয়ে নেওয়া। ধরা পড়লে কানমোলা অথবা ছিপটির বাড়ি খাওয়া।

পুরানো সেই দিনের কথা

পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়। ও সেই চোখে দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।।

স্কুলের পর কেটে গেছে অনেকটা সময়। যে যার মতন বাঁচতে শিখে গেছে। কিন্তু হঠাৎ একটি পুরোনো বন্ধুর লেখা ‘কিরে কেমন আছিস?’ লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় ফেসবুকে। ঝলমল করছে ১০ বছর দেখা না হওয়া হাসিহাসি মুখটি। দুদিকে বিনুনি করা ছোট্ট মেয়েটির মুখ এখন সংসারী। কিংবা সদ্য গজিয়ে ওঠা গোফের পরিবর্তে জায়গা নিয়েছে চাপ দাড়ি।চূড়ান্ত ফাজিল ছেলেটির মুখে আজ গাম্ভীর্যের ছাপ। হঠাৎ করে ফিরে পাওয়া পুরোনোকে, ফিরে পাওয়া স্কুল জীবনকে।

পুরোনো কে পাথেয় করে এগিয়ে চলা। আমরাতো আর ছোট নই আর ছোট নই  যেখানেই থাকি সেখানেই  ভালো থাকবো

কালের পরিসীমা অতিক্রম করে আজ আমরা প্রত্যেকেই বড়। নিজের সন্তান দের মধ্যে দেখতে পাই নিজেদের প্রতিচ্ছবি। ছোট গুলোর মধ্যে দিয়ে ই নতুন করে আবার নিজেকে খুঁজে পাওয়া।নতুন করে পাওয়া। নতুন করে জানা।

শেষকথা

মুছে যাওয়া দিন গুলি আমায় যে পিছু ডাকে – এই গান টির  লাইন গুলি আজকের বাস্তব সত্য। স্কুল জীবনের প্রেম , স্কুল জীবনের আড্ডা, স্কুল জীবনের ঝগড়া, মারামারি , আদর , মাস্টারমশাইয়ের সাহচর্য  কিছুই ভোলার নয়, ভুলিওনি, ভুলবও না।

লেখক – শ্রেয়া মৈত্র চ্যাটার্জী