বাত জ্বরের চিকিৎসা – Rheumatic Fever Treatment in Bengali

আমরা সাধারণত জ্বর এর কথা শুনেছি আমাদের কম বেশি সবারই হয়ে থাকে।  বাতজ্বর কথাটি কতজন শুনেছেন জানিনা। তবে বন্ধুরা বাতজ্বর কিন্তু  এবং সেটা অনেকেরই হয়ে থাকে। বাতজ্বর হলো প্রদাহজনিত রোগ যা হার্ট, চর্ম, জয়েন্ট, মস্তিষ্ক কে আক্রান্ত করতে পারে। এই রোগ সাধারণত গলায় সংক্রমণের দুই থেকে চার সপ্তাহ পরে শুরু হয়। লক্ষণসমূহ হচ্ছে জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা,কোরিয়া, ইরায়থেমা মারজিনেটাম। প্রায় অর্ধেক ক্ষেত্রে হার্ট আক্রান্ত হয়। বাতজ্বরের জন্য দায়ী ব্যাক্টেরিয়া হলো স্ট্রেপটোকক্কাস পায়োজেনস। এই রোগে ব্যক্তির নিজের শরীরের টিস্যুর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। তবে যাদের শরীরে এই রোগের জিন রয়েছে তারা অন্যদের তুলনায় খুব সহজে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে পুষ্টিহীনতা, দারিদ্র্য প্রভৃতি। এই রোগ শনাক্ত করার ক্ষেত্রে উপসর্গগুলোর পাশাপাশি স্ট্রেপ্টোকক্কাস দ্বারা সংক্রমিত হবার প্রমাণ থাকা জরুরি। স্ট্রেপ্টোকক্কাস দ্বারা কণ্ঠনালীর সংক্রমণে পেনিসিলিন দ্বারা চিকিৎসা করালে বাতজ্বর হবার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়।

বাতজ্বর কি

বাতজ্বর এমন একটি রোগ যা সারা শরীরে বিশেষ করে হৃদপিণ্ড, গিরা এবং স্নায়ুতন্ত্রে কোষে প্রদাহ সৃষ্টি করে৷ এটা হৃদপিণ্ডের ভাল্বের সমস্যার জন্য বিশেষভাবে দায়ী৷ বাতজ্বরে সাধারণত ৫-১৫ বছরের শিশুরা বেশী আক্রান্ত হয়। প্রতিবছর প্রায় ৩২৫০০০ জন শিশু বাতজ্বরে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় ১৮ মিলিয়ন লোক বাতজ্বর সংক্রান্ত হৃদরোগে আক্রান্ত। বাতজ্বর রোগীদের বয়স সাধারণত ৫ থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে ২০% ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্করাও প্রথমবারের মত আক্রান্ত হতে পারে। উন্নত দেশগুলোর আদিবাসী লোকজন ও উন্নয়নশীল দেশে এই রোগের প্রাদূর্ভাব বেশি। ২০১৩ সালে এই রোগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ২৭৫০০০ জন যেখানে ১৯৯০ সালে ছিলো প্রায় ৩৭৪০০০ জন। অধিকাংশ মৃত্যুর ঘটনা ঘটে উন্নয়নশীল দেশে যেখানে প্রতিবছর প্রায় ১২.৫% রোগী মৃত্যুবরণ করে এই রোগের বর্ণনা খৃস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে হিপোক্রেটিসের লেখায় পাওয়া যায়। বাতরোগের অনেক উপসর্গের সাথে এই রোগের উপসর্গের মিল থাকায় এই রোগের নাম বাতজ্বর রাখা হয়েছে।

মনে রাখার বিষয় 

  • বাতজ্বর নির্ণয় করা সম্ভব হলে একটি শিশুকে দীর্ঘদিন অর্থাৎ বছরের পর বছর ধরে পেনিসিলিন ইনজেকশন বা বড়ি গ্রহন করতে হয়। তাই, এ রোগ আছে কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চিকিৎসা শুরু করা উচিত।
  • বাতজ্বরে সাধারনত গলা, পিঠ, হাত ও পায়ের ছোট ছোট গিরা আক্রান্ত হয় না।
  • স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে টনসিল অথবা গলার প্রদাহ হলে রক্তে এএসও টাইটার বাড়ে। যেহেতু যেকোনো নিরীহ টনসিল সংক্রমণেই এ পরীক্ষার রিপোর্ট অস্বাভাবিক আসতে পারে, তাই রক্তে এএসও টাইটার বৃদ্ধি পেলেই এটি বাতজ্বরের কোনো নিশ্চিত ও একমাত্র প্রমাণ নয়। বাতজ্বরের অনেকগুলো সুস্পষ্ট লক্ষণ ও উপসর্গ রয়েছে, যেগুলোর সমন্বয়ে রোগটি নির্ণয় করতে হয়।

৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে হূৎপিণ্ডে প্রদাহ হয় না।

বাতজ্বর কেন হয় ?

  • বাতজ্বরে সাধারনত বিটা হেমোলাইটিক স্ট্রেপটোকক্কাস নামক এক ধরনের জীবাণুর সংক্রমনের কারনে হয়। দারিদ্র্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, ঠাণ্ডা ও স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে এবং অজ্ঞতাই এ রোগের প্রধান কারণ। এছাড়াও, যেসব শিশু দীর্ঘ দিন ধরে খোসপাঁচড়া ও টনসিলের রোগে আক্রান্ত, তাদেরও বাতজ্বরে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনেক বেশি। যাতে করে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় তাতে করে আমাদের সব্বাইকে মনে রাখতে হবে যে আমরা এরকম ভাবে থাকবো না। আমরা সবসময় পয়পরিস্কার থাকবো যাতে করে বাতজ্বর কোনো কোনো জ্বরই না হয় বা অন্তত চেষ্টা তো করবো।
  • এক ধরনের ব্যাক্টেরিয়ার আক্রমণে বাতজ্বর হয়ে থাকে৷ এই জীবাণুর চিকিৎসা না করলে ২০ দিনের মধ্যে বাতজ্বরের লক্ষণসমূহ দেখা দিতে পারে৷ প্রথমে শিশুদের টনসিলের সমস্যা এবং জ্বর, গলাব্যথা দেখা দেয় এবং কয়েক দিনের মধ্যে ভাল হয়ে যায়৷ তারপর ২-৩ সপ্তাহ পরে বাতজ্বরের লক্ষণসমূহ দেখা দেয়৷

বাত জ্বরের লক্ষণ ও উপসর্গ 

  • জ্বর
  • অস্থিসন্ধিতে মৃদু বা তীব্র ব্যথা যা প্রায়ই পায়ের গোড়ালি, হাঁটু, কনুই অথবা হাতের কবজি এবং কখনো কখনো কাঁধ, কোমর, হাত, পায়ের পাতায় হয়ে থাকে।
  • ব্যথা সাধারণত এক অস্থিসন্ধি থেকে আরেক অস্থিসন্ধিতে ছড়িয়ে পড়ে যা মাইগ্রেটরি পলি-আর্থ্রাইটিস নামে পরিচিত।
  • জয়েন্ট লাল,উষ্ণ ও ফোলা থাকে।
  • ত্বকের নিচে ক্ষুদ্র ব্যথাহীন পিন্ড বা সাবকিউটেনিয়াস নডিউল থাকে।
  • বুকে ব্যথা ও বুক ধড়ফড় করে,
  • অল্পতে ক্লান্ত বা দুবর্ল বোধ হয়,
  • শ্বাসকষ্ট হয় ইত্যাদি।

মুখ্য ও গৌণ কিছু উপসর্গ

  • বাতজ্বরের মুখ্য ও গৌণ কিছু উপসর্গ আছে, যার সমন্বয়ে রোগ নির্ণয় করতে হয়। যদি দুটি মুখ্য উপসর্গ ও একটি গৌণ উপসর্গ মিলে অথবা একটি মুখ্য উপসর্গের সঙ্গে দুটি গৌণ উপসর্গ মিলে যায় এবং এর সঙ্গে স্ট্রেপটোকক্কাস ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ প্রমাণিত হয়, তবেই কেবল বাত জ্বর হয়েছে বলে নিশ্চিত হতে হবে।
  • চামড়ার নিচে ক্ষুদ্র ব্যথাহীণ পিন্ড অথবা ত্বকে লালচে দাগ, অস্থিসন্ধির প্রদাহজনিত ব্যথা ও ফুলে যাওয়া, একটি সন্ধি ভালো হয়ে গেলে এটি আবার অন্যটিকে আক্রমণ করে, স্নায়ুজটিলতায় পেশির অস্বাভাবিক চলন, হূৎপিণ্ডের প্রদাহ বা কার্ডাইটিস ইত্যাদি।
  • জ্বর, অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, রক্তে ইএসআর বা সিআরপি বৃদ্ধি, অল্পতে ক্লান্ত বা দুবর্ল বোধ করা, বুকে ব্যথা বা বুক ধড়ফড় করা, শ্বাসকষ্ট, ইসিজিতে বিশেষ পরিবর্তন ইত্যাদি।

কখন ডাক্তার দেখাবেন?

শিশুর গলায় ব্যথা হলে অথবা টনসিলের সমস্যা হলে এবং এর লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহনের মাধ্যমে বাত জ্বর প্রতিরোধ করা যায়। কিছু কিছু লক্ষণ এবং উপসর্গ দেখা দেওয়ার সাথে সাথে শিশুকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে, যেমন- গলায় ব্যথার সাথে গলায় ফোলা ভাব থাকলে, কোন কিছু খেতে সমস্যা হলে, ঠান্ডার কোন উপসর্গ ছাড়াই নাক দিয়ে পানি পড়লে, গিরা বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা থাকলে, নাক দিয়ে রক্ত আসলে যা সাধারনত ৩ বছরের কম বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় ইত্যাদি।

প্রতিরোধ

শিশুর পরিমিত পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। শিশুর শরীরের পুষ্টিমান সঠিক হলে গলায় জীবাণুর আক্রমণের পরেও বাত জ্বর হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে। অপরদিকে ছোটবেলায় দীর্ঘদিন ধরে অপুষ্টিতে আক্রান্ত, যেসব শিশুর রক্তে আমিষ ও লৌহের অভাব রয়েছে, তাদের বাতজ্বর হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তাই শিশুর সঠিক পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। বাতজ্বরের জীবাণু নাক, গলা ও ত্বকে বাস করে। অপরিষ্কার থাকলে, ঘরদোর পরিচ্ছন্ন-পরিচ্ছন্ন না রাখলে এ রোগের জীবাণু একজন থেকে অন্যজনে ছড়াতে পারে। প্রতিদিন সাবান দিয়ে গোসল করলে, হাত ও নাক পরিষ্কার রাখলে, প্রতিদিন অন্তত একবার গড়গড়া করে গলা পরিষ্কার করলে এ রোগের জীবাণুর আক্রমন প্রতিরোধ করা সম্ভব হতে পারে। প্রথম থেকেই গলায় সংক্রমণের সঠিক চিকিৎসা গ্রহন করলে বাত জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে যায়। স্ট্রেপ্টোকক্কাস ব্যাকটেরিয়া দ্বারা কণ্ঠ নালীর সংক্রমণ হলে, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করে বাতজ্বর প্রতিরোধ করা যায়।

চিকিৎসা

পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিতে হবে ও আক্রান্ত জয়েন্ট নড়াচড়া করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যথানাশক ঔষধ হিসেবে অ্যাসপিরিন খুবই কার্যকর। প্রদাহ কমানোর জন্য অ্যাসপিরিনের পাশাপাশি কর্টিকোস্টেরয়েড যেমন প্রেডনিসোলন ব্যবহৃত হয়। এর পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক যেমন ফিনক্সিমিথাইলপেনিসিলিন, বেনজাথিন পেনিসিলিন ও ইরাইথ্রোমাইসিন প্রভৃতি ব্যবহৃত হয়। ব্যথা এবং রোগের অন্যান্য উপসর্গ ভালো না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে প্রয়োজনে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে এবং আক্রান্ত জয়েন্ট নড়াচড়া করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ব্যথানাশক ঔষধ হিসেবে অ্যাসপিরিন খাওয়া যেতে পারে। প্রদাহ কমানোর জন্য অ্যাসপিরিনের পাশাপাশি কর্টিকোস্টেরয়েড যেমন- প্রেডনিসোলন ব্যবহার করা যেতে পারে। এর পাশাপাশি অ্যান্টিবায়োটিক যেমন- বেনজাথিন পেনিসিলিন, ফিনক্সিমিথাইল পেনিসিলিন, ইরাইথ্রোমাইসিন প্রভৃতি ব্যবহার করা যেতে পারে। যেকোনো ঔষধ সেবনের পূর্বে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ গ্রহন করতে হবে।

শেষ কথা 

বাতজ্বর কোনো ছোঁয়াচে রোগ নয়। বাতজ্বরের রোগীর সঙ্গে থাকলে, খেলে, ঘুমালে এমনকি ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করলেও বাত জ্বর হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। গর্ভাবস্থায় মা থেকে শিশুর দেহে সংক্রমণের কোন আশঙ্কা নেই। কিন্তু স্ট্রেপ গলদাহের সময় কাছাকাছি থাকলে অথবা বেশি কাছ কথা বললে অন্যের মধ্যে জীবাণুর সংক্রমন হতে পারে। গিরা ফোলা অথবা ব্যথাসহ জ্বর আরও অনেক রোগে হতে পারে, তাই গিরাব্যথা হলেই বাতজ্বর হয়েছে বলে মনে করবেন না। বাত জ্বরের গিরা ফোলা বা ব্যথা কিন্তু সহজেই ভালো হয়ে যায়। তাই চিকিৎসা নেওয়া সত্ত্বেও কোনো রোগীর গিরাব্যথা ভালো না হলে, সেক্ষেত্রে বাতজ্বর না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। চিন্তার কোনো কারণ নেই। মানুষের জীবনে রোগটা একটা রুজকার ব্যপার তার পতিরোধটাও আমাদের করতে হবে।

লেখক – শান্তনু পাল