এজমা রোগের প্রতিকার – Asthma Symptoms and Treatment in Bengali

এজমা যেটাকে আমরা বলি শাসকষ্ট বা এটা হাঁপানির টান নামেও পরিচিত। এখন ঘরে ঘরে এই রোগে আক্রান্ত মানুষ দেখতে পাওয়া যায় বা শোনা যায়। সারা বিশ্বের প্রায় ১০ কোটি লোক শ্বাসনালির সচরাচর সমস্যা এজমায় আক্রান্ত হয়। তাদের ৯০% এরও বেশি অত্যাধুনিক চিকিৎসা পায় না এবং অনেক রোগী মারা যায়। যদিও এ মৃত্যুর ৮০% প্রতিরোধ করা সম্ভব যদি আধুনিক চিকিৎসা ও ডাক্তারের তদারকির মাধ্যমে এজমা নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেয়া যায়। সবার আগে আমাদের জেনে নিতে হবে এজমা জিনিস টা কি ? কথা থেকে এই রোগের উৎপত্তি ? কোনো হয় ? এর লক্ষণ কি কি ? এর প্রতিরোধ কি কি ? ইত্যাদি ইত্যাদি।

এজমা কি ?

এজমা বা হাঁপানি আসলে শ্বাসনালির অসুখ। যদি কোন কারণে শ্বাসনালিগুলো অতিমাত্রায় সংবেদনশীল (হাইপারসেনসিটিভ) হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন ধরনের উত্তেজনায় উদ্দীপ্ত হয় তখন বাতাস চলাচলের পথে বাধার সৃষ্টি হয়, ফলে শ্বাস নিতে বা ফেলতে কষ্ট হয়। সাধারণত এই এজমা বা হাঁপানি শীতকালেই বেশি জাকরে ধরে। তার মানে এই নয় যে অন্য কোনো ঋতুতে হয় না। সব ঋতুতেই হয়ে থাকে তবে শীতকালে এর প্রভাব বেশি। 

কেন হয় ?

জেনেটিক কারণে কারও কারও বেশি হয়ে থাকে। হ্যা বন্ধুরা এজমা কিন্তু জেনেটিক কারণেও হয়। অর্থাৎ আমাদের বা কারোর পূর্বপুরুষদের মধ্যে যেমন দাদু, ঠাকুমা, দিদা, কাকা, কাকিমা, এমনকি বাবা, মা এর থাকলেও এই এজমা কিন্তু আপনারও হতে পারে। তার মানে এই না যে হবেই। এ ছাড়া ঘরবাড়ির ধুলো ময়লায়, রাস্তাঘাট এধুলোবালি, মাইট পোকা, ফুলের বা ঘাসের পরাগ রেণু, পাখির পালক, জীব-জন্তুর পশম, ছত্রাক, কিছু খাবার, কিছু ওষুধ ও নানারকম রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি থেকে এলার্জিজনিত এজমা হয়ে থাকে। আবার এমন অনেক মানুষ দেখা গাছে ঠান্ডা জাতীয় কোনো জিনিস যেমন – ঠান্ডা ফ্রিজের জল,আইস ক্রিম, বা যেকোনো ঠান্ডা জিনিস যেটা ফ্রিজের ঠান্ডা হয় এরকম কোনো খাবার বা পানীয়তেও কিন্তু আপনার এই এজমা হতে পারে ( এতটাই জোর দিয়ে বলছি কারণ আমার নিজের পরিবারের মানুষরা এতে আক্রান্ত ) একটু এইসব জিনিসগুলো একটু এড়িয়ে চলবেন।  

কাদের হতে পারে এজমা বা হাঁপানি ?

যে কোন বয়সে স্ত্রী, পুরুষ, শিশু-কিশোর যে কারও হতে পারে। যাদের রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের হাঁপানি আছে তাদের এ রোগ হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আবার দাদু, ঠাকুমা, বা দিদা, দাদুর  হাঁপানি থাকলে (বাবা-মার না থাকলেও) নাতি-নাতনি বা তাদের ছেলেমেয়েরা এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। পিতৃকুলের চেয়ে মাতৃকুল থেকে হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এর তেমন কোনো বয়স হয় না যে কোনো বয়সের মানুষদের হতে পারে, তবে খুব বাচ্চা শিশুদের এটা সাধারণত হয় না বা হলেও সামান্য সেটাও বোঝা যায় না। 

এজমাতে কেন এই শ্বাসকষ্ট ?

আমাদের শ্বাসনালি গুলি খুবই ক্ষুদ্র। ২ মিমি থেকে ৫ মিমি ব্যাস বিশিষ্ট। চারদিকে মাংশপেশি পরিবেষ্টিত। এ ক্ষুদ্র শ্বাসনালির ভেতর দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় খুব সহজেই বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে। যদি কখনও এলার্জিক বা উত্তেজক কোন জিনিস শরীরে প্রবেশ করে তখন শ্বাসনালির মাংস পেশিগুলো সঙ্কুচিত হয়। ফলে শ্বাসনালি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় আঠালো মিউকাসজাতীয় কফ আর ইনফেকশনের কারণে শ্বাসনালির ভেতরের দিককার মিউকাস আবরণী ফুলে ওঠা। ফলে শ্বাস নিতে এবং ফেলতে কষ্ট হয়। আর মিউকাসজাতীয় আঠালো কফ উঠিয়ে ফেলার লক্ষ্যে অনবরত কাশি হতে থাকে। কখনও কখনও এই শ্বাসনালি এত সরু হয় যে, বাতাস বায়ুথলিতে পৌঁছায় না তখন শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়। এটা খুবই মারাত্মক অবস্থা। এ অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে অক্সিজেনের অভাবে রোগীর মৃত্যু ঘটতে পারে। 

এজমা কি ছোঁয়াচে রোগ ?

আমাদের মধ্যে এই কৌতূহল তা বেশ পুরোনো যে ইটা ছোঁয়াচে কিনা বা ওটা ছোঁয়াচে কিনা, এজমা ছোঁয়াচে রোগ নয়। পারিবারিক বা বংশগতভাবে এজমা হতে পারে। এটিকে আমরা জেনেটিক ও বলতে পারি।  শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খেয়ে এজমায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। মার সংস্পর্শ থেকেও হওয়ার আশঙ্কা নেই।

বংশগতভাবে এজমার রিস্ক কতটা ?

মাতৃকুলে হাঁপানি থাকলে তিনগুণ বেশি রিস্ক আর পিতৃকুলে হাঁপানি থাকলে অনেকটা কম রিস্ক। মায়ের হাঁপানি থাকলে মোটামোটিভাবে বলা যায় তিন সন্তানের মধ্যে একটির হাঁপানি একটির আপাত সুস্বাস্থ্য এবং একটির অস্বাভাবিক শ্বাসনালির সঙ্কোচন থাকতে পারে। শেষেরটির হাঁপানি না হয়ে সর্দি-কাশির প্রবণতা থাকতে পারে। কিন্তু সবসময় এটা কার্যকর নাও হতে পারে। 

এজমা কীভাবে চিহ্নিত করা যায় ?

  • এজমা রোগের প্রধান উপসর্গ বা লক্ষণগুলো হলো। 
  • বুকের ভেতর বাঁশির মতো সাঁই সাঁই আওয়াজ। 
  • শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট। দম খাটো অর্থাৎ ফুসফুস ভরে দম নিতে না পারা
  • ঘন ঘন কাশি।
  • বুকে আঁটসাঁট বা দম বন্ধ ভাব।
  • রাতে ঘুম থেকে উঠে বসে থাকা।

এজমা থেকে কি কি বিপদ হতে পারে ?

মারাত্মক জটিল এজমা হতে পারে। স্থায়ী পুরনো এজমায় পরিবর্তন হতে পারে। স্থায়ী পুরনো এজমা থেকে হার্টফেল হয়ে জল আসতে পারে এবং রোগী শয্যাশায়ী হয়ে যেতে পারে। শরীরে সবসময় অক্সিজেন কম থাকতে পারে। তাই সবসময় অবসাদগ্রস্ত মনে হবে। অক্সিজেনের অভাবে স্মৃতিশক্তি কমতে থাকে এবং অকালে নিজেকে বৃদ্ধদের মতো দুর্বল মনে হবে। ফুসফুসের অংশ বিশেষ চুপসে যেতে পারে। নিমোনিয়াও হতে পারে। পায়ে জল আসতে পারে। মুখ থেকে ছিটেফোঁটা রক্ত বেরিয়ে আসতে পারে। এ ক্ষেত্রে কাশি বন্ধ করার ওষুধটা দেয়া জরুরি। এবং খুব যদি বাড়াবাড়ি হয়ে যায় যখন তখন আপনার সু চিকিৎসা না হবার দরুন আপনি মারাও যেতে পারেন। 

পরীক্ষা-নিরীক্ষা 

রক্ত পরীক্ষা বিশেষত ইয়োসিনোফিলের মাত্রা বেশি আছে কি না তা দেখা। সিরাম আইজিইয়ের মাত্রা সাধারণত এজমা রোগীদের ক্ষেত্রে আইজিইয়ের মাত্রা বেশি থাকে। স্কিন প্রিক টেস্ট এ পরীক্ষায় রোগীর চামড়ার ওপর বিভিন্ন এলারজেন দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং এ পরীক্ষাতে কোন কোন জিনিসে রোগীর এলার্জি আছে তা ধরা পরে। বুকের এক্স-রে করে দেখা প্রয়োজন যে অন্য কোন কারণে রোগীর শ্বাসকষ্ট কি না।

এজমা চিকিৎসা 

উপশমকারী ওষুধ ৫-১০ মিনিট পর আবার নিতে হবে। নিজেকে শান্ত রাখুন, স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিতে চেষ্টা করুন। যেভাবে বসলে আরাম লাগে সেভাবে বসুন। আপনার হাত হাঁটুর ওপরে রাখুন, যাতে সোজা হয়ে বসে থাকতে পারেন। শ্বাস তাড়াহুড়া করে নেবেন না, তড়াহুড়া করে শ্বাস নিলে অবসাদগ্রস্ত হয়ে যাবেন। যত দ্রুত সম্ভব ডাক্তার বা সাহায্যকারীর শরণাপন্ন হোন।

এজমা চিকিৎসা পদ্ধতি

এজমা চিকিৎসার তিনটি প্রধান উপায় 

  •  এলাজেন পরিহার : হাঁপানির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো যে জিনিসে এলার্জি তা যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলা। তাই এজমা রোগীদের প্রথমেই এলার্জি টেস্ট করে জানা দরকার তার কিসে কিসে এলার্জি হয়।
  • ওষুধপত্র : নানা ধরনের হাঁপানির ওষুধ আছে। প্রয়োজন মতো ওষুধ ব্যবহার করে রোগী সুস্থ থাকতে পারেন। সাধারণত দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
  1. শ্বাসনালির সঙ্কোচন বন্ধ করতে ওষুধ ব্যবহার করা, যেমন ব্রঙ্কোডাইলেটর, নালবিউটামল, থিউফাইলিন, ব্যামবুটারল
  2. প্রদাহ নিরাময়ের ওষুধ, যেমন কার্টিকোস্টেরয়েড (বেকলোমেথাসন, ট্রাইএমসিনোলোন, ফ্লোটিকাসন) এগুলো ইনহেলার, রোটাহেলার, একুহেলার ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং লিউকোট্রাইন নিয়ন্ত্রক মন্টিলুকাস্ট , জেফিরলুকাস্ট ব্যবহার করা।
  • এলার্জি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপি : এলার্জি দ্রব্যাদি থেকে এড়িয়ে চলা ও ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাকসিন ও এজমা রোগীদের সুস্থ থাকার অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি। এ পদ্ধতি ব্যবহার কর্টিকোস্টেরয়েডের ব্যবহার অনেক কমে যায়। ফলে কর্টিকোস্টেরয়েডের বহুল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকেও রেহাই পাওয়া যায়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্বে স্বাস্থ্য সংস্থও এ ভ্যাকসিন পদ্ধতি চিকিৎসাকে এজমার অন্যতম চিকিৎসা বলে অভিহিত করে। এটাই এজমা রোগীদের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থ থাকার একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি। বর্তমানে বাংলাদেশেও এ পদ্ধতিতে চিকিৎসার পরামর্শ দেয়া হয়।
  • এই চিকিৎসার মধ্যে একটা চিকিৎসা বলাই যায় যেটা এখন বর্তমান যুগের খুব প্রচলিত যদিও সেটা চিকিৎসা বলা ভুল।  সেটা হল ইনহেলার। এই ইনহেলার এর মাধ্যমে তৎক্ষণাৎ হাঁপানি বা শাসকষ্ট কে থামিয়ে দেওয়া যায়।  তবে বন্ধুরা ইটা কিন্তু কোনো নিরাময়ের চিকিৎসা নয়। এটা হল তাৎক্ষণিক শাসকষ্টকে স্বাভাবিক আনার জন্য ব্যাবহার করা হয় মাত্র। ( ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করেই তবেই সঠিক ইনহেলার ব্যবহার করবেন )

শেষ কথা 

আগে ধারণা ছিল এজমা একবার হলে আর সারে না। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। প্রথমদিকে ধরা পড়লে এলার্জিজনিত এজমা রোগ একেবারে সারিয়ে তোলা সম্ভব। অবহেলা করলে এবং রোগ অনেক দিন ধরে চলতে থাকলে নিরাময় করা কঠিন হয়ে পড়ে। উন্নত দেশের সব প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা বর্তমানে বাংলাদেশেই রয়েছে। অপচিকিৎসা নিয়ে মৃত্যুবরণ কিংবা বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় করে বিদেশে যাওয়ার কোন দরকার নেই। একটু সাবধান ভাবে চললেই কিন্তু আপনি আপনার বা আপনার পরিবারের এজমার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। অনেকেই আছে যে নানা রকম তাবিজ আর কবজ এ ভালো থাকে বা ভালো আছেন দীর্ধদিন , যদিও বিজ্ঞান এটাকে মানে না বা অনেক মানুষরাও মানেন না ব্যাপারটাকে। ওই যে কোথায় আছে না যে বিশ্বাসে মিলে বস্তু তর্কে বহু দূর। সেই বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করেই বেঁচে থাকে বা ভালো থাকে। যাই হোক আপনাকে সচেতন থাকতে হবে। একদম ঠান্ডা কোনোপানীয় বা ফ্রিজের কোনো ঠান্ডা জিনিস থেকে শত হাত দূরে থাকুন। আশা করি ভালো থাকবেন। ধন্যবাদ।