বিশ্বের বিভিন্ন জায়গার লক্ষ লক্ষ লোক মানষিক রোগে আক্রান্ত হয় আর এটা তাদের প্রিয়জনদের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে। প্রতি চার জনের মধ্যে এক জন তাদের জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে এর দ্বারা আক্রান্ত হবে। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা এই অসুস্থতার পিছনে একটা বড়ো কারণ হল অবসাদ। স্কিৎজোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডার হল সবচেয়ে দুঃসহ ও ক্ষতিকর মানষিক রোগের মধ্যে অন্যতম। যদিও অনেক লোক এতে আক্রান্ত হয়, তবুও লোকেরা মানষিক রোগকে গোপন করে রাখে, উপেক্ষা করে এবং এটাকে খারাপ চোখে দেখে। আপনার অথবা আপনার কোনো প্রিয়জনের যদি মানষিক রোগ ধরা পড়ে, তাহলে আপনার কেমন লাগবে? আনন্দের বিষয় হল, মানষিক রোগের চিকিৎসা করা সম্ভব। প্রথমেই আমাদের জানতে হবে যে মানষিক রোগটা কি ? আসুন আমরা কয়েকটা বিষয় পরীক্ষা করে দেখি, যেগুলো আমাদের মানষিক রোগকে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
মানষিক রোগ কী ?
বিশেষজ্ঞদের মতে, মানষিক রোগ হল, একজন ব্যক্তির সুস্থভাবে চিন্তা করতে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সঠিকভাবে আচরণ করতে না পারা। এই অবস্থা প্রায়ই একজন ব্যক্তির অন্যদের কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার এবং জীবনের প্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে মোকাবিলা করার ক্ষমতাকে ব্যাহত করে।ব্যক্তি-বিশেষ এবং অসুস্থতা ও পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে রোগের লক্ষণ হয়তো ভিন্ন হতে পারে। লিঙ্গ, বয়স, সংস্কৃতি, জাতি, ধর্ম অথবা শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং ধনী-গরীব নির্বিশেষে সকলেই এতে আক্রান্ত হতে পারে। মানসিক রোগ কোনো ব্যক্তিগত দুর্বলতা অথবা চারিত্রিক ত্রুটির ফল নয়। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ব্যক্তি-বিশেষদের চিকিৎসা সম্ভব এবং তারা এক ফলপ্রসূ ও আনন্দময় জীবন কাটাতে পারে।
মানষিক রোগের লক্ষণ
অনেক সময় নিজের অজান্তেই মানষিক সমস্যা গ্রাস করতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে সমস্যাটি সঠিক সময়ে নির্ণয় করা সম্ভব না হলে তা পরবর্তী সময়ে বেড়ে যেতে পারে। অন্যান্য রোগের মতোই মানষিক সমস্যাও একটি রোগ। এ রোগ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা শুরু করলে আরোগ্যলাভও সহজ হয়। এ লেখায় তুলে ধরা হলো মানসিক সমস্যার কয়েকটি লক্ষণ।
অসামাজিক হয়ে ওঠা
মানুষ সামাজিক প্রাণী। বেঁচে থাকার জন্য অন্যান্য মানুষের সঙ্গে মেলামেশার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু আপনি যদি বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও পরিচিত মানুষদের এড়িয়ে চলেন তাহলে তা মোটেই স্বাভাবিক বিষয় নয়। আপনার ক্ষেত্রে যদি এমনটা হয় তাহলে তা গুরুত্বের সঙ্গে নিন। এ ক্ষেত্রে অন্যের সমস্যা খোঁজার আগে আপনার কোনো মানসিক সমস্যা হয়েছে কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত হোন।
মনোযোগ প্রদানে ব্যর্থতা
মানষিক সমস্যা হলে মন সর্বদা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। আর এ ধরনের পরিস্থিতিতে কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে অসংখ্য বিষয় মনের মাঝে খেলা করে। আপনার মন যদি সর্বদা বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে তাহলে কোনো বিষয় মনে রাখা যেমন কঠিন হবে তেমনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়াও সহজ হবে না। এ ধরনের পরিস্থিতি প্রায়ই মানসিক সমস্যার লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়।
ঘুমের সমস্যা
বিষণ্নতায় আক্রান্ত বহু মানুষকেই সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করতে দেখা যায়। মানসিক অস্থিরতার কারণে রাতে ঘুমাতেও অনেকের দেরি হয়। এ ছাড়া ঘুমের সময় চোয়াল শক্ত রাখা কিংবা দাঁত কিড়মিড় করা অনেকের মানষিক সমস্যা নির্দেশ করে। ঘুমের এ ধরনের নানা অস্বাভাবিকতা মানসিক সমস্যা নির্দেশ করে।
বিচ্ছিন্নতা
মানষিক সমস্যার কারণে অনেকেরই পরিস্থিতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়। এ ধরনের সমস্যার একটি উদাহরণ হতে পারে একটি মিটিং; যেখানে স্বাভাবিকভাবে আপনি অন্য সবার মতো অংশ নিলেও বাস্তবে আপনার সঙ্গে সবার বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে। আপনি হয়তো মিটিংয়ে বসে আছেন কিন্তু কী বিষয়ে কথা হচ্ছে, তার কিছুই ধরতে পারছেন না।
শারীরিক সমস্যা
মানষিক সমস্যা প্রায়ই শারীরিক সমস্যা হিসেবে দেখা দেয়। যেমন অনেকেরই মানসিক সমস্যার কারণে বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা, ঘাম, আতঙ্ক ইত্যাদি দেখা যায়। এছাড়া রোগী এমন শারীরিক সমস্যার কথা বলতে পারে, যার কোনো ভিত্তি নেই। বিষণ্ণতা রোগীদের অনেকেই দুর্বলতায় ভোগে।
মানষিক রোগের চিকিৎসা
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা সফলভাবে অনেক মানষিক রোগের চিকিৎসা করতে পারেন। তাই, প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল, কোনো অভিজ্ঞ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে সম্পূর্ণ চেক আপ করানো।
কিন্তু,মানষিক সাগ্রহণ করবে। এর জন্য হয়তো সেই রোগীকে নিজের মানসিক রোগ সম্বন্ধে অন্যদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে অনিচ্ছাকে দূর করতে হবে। চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে, এমন মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলা, যারা তাদেরকে তাদের রোগ সম্বন্ধে বুঝতে, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমাধান করতে এবং চিকিৎসা বন্ধ না করার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সাহায্য করতে পারেন। ডাক্তারের সঙ্গে এই ধরনের আলোচনার সময় পরিবারের কোনো সদস্য অথবা বন্ধু আশ্বাস ও সমর্থন জোগানোর ক্ষেত্রে এক বড়ো ভূমিকা পালন করতে পারেন।
অনেকে তাদের অবস্থাকে ভালোভাবে বোঝার এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করার পর, তাদের মানষিক রোগের সঙ্গে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে, আমরা নির্ভরযোগ্য মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও সেইসঙ্গে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সমর্থন থেকে অনেক উপকার পেয়েছি।”
প্রথমেই ডাক্তাররা ভাল ভাবে রোগীকে পরীক্ষা করেন। সেই পরীক্ষার ফলাফলের ওপর নির্ভর করে যে কোন চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হবে। সামান্য উপসর্গের ক্ষেত্রে অল্প দিনের জন্য চিকিৎসা হলেই যথেষ্ট। কিন্তু গুরুতর ক্ষেত্রে মনোবিদ,মানষিক রোগের চিকিৎসক, এবং সেচ্ছাসেবীরা একত্রে মিলে চিকিৎসায় সাহায্য করে। নিচে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতির বিবরণ দেওয়া হল।
থেরাপি
মানষিক সাস্থের উন্নতির উদ্দেশ্যে ওষুধের পাশাপাশি এক বা একাধিক থেরাপির পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। পুরোটাই নির্ভর করছে রোগীর মানসিক ও শারীরিক সাস্থের ওপর।
সাইকোথেরাপই
এই পদ্ধতি অনুসারে একজন রোগ বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে রোগীর অবাস্তব ও ভ্রান্ত চিন্তাভাবনা পরিবর্তন করে ইতিবাচক ও যুক্তিসম্মত চিন্তা আনতে সাহায্য করেন। চিকিৎসক রোগীকে তাঁর সমস্যা খুলে বলতে সাহায্য করেন। নিজের সমস্যা নিজে বুঝতে পারলে বাকি চিকিৎসা খুব সহজ হয়ে যায়।
সিবিটি বা কগ্নিটিভ বিহেভিওরাল থেরাপি
কগ্নিটিভ এবং বিহেভিওরাল থেরাপির যুগল। এই পদ্ধতিতে রোগীর চিন্তাভাবনা ও চালচলনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়। সিবিটির সাহায্যে রোগী নিজের সমস্যা নিজে বুঝে তা সমাধানের চেষ্টা করতে পারেন। চিকিৎসক এবং রোগী উভয়কেই এখানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হয়। চিকিৎসক এখানে রোগীকে তাঁর নিজের অসংলগ্ন চিন্তা ভাবনাকে চিনতে সাহায্য করেন। সেইজন্য চিকিৎসক রোগীকে দৈনিক কিছু কাজ যেমন ডাইরি লেখা বা নিজের অস্বভাআবিক চিন্তা ভাবনার কারণ লক্ষ করা এবং সুন্দর ইতিবাচক ঘটনা গুলি রেকর্ড করে রাখতে বলেন। ডিপ্রেশন, অ্যাংজাইটি, ইটিং ডিস্অর্ডার ও বাইপোলারের চিকিৎসায় সিবিটির প্রয়োগ করা যেতে পারে।
ইন্টারপার্সোনাল থেরাপি বা আইপিটি
রোগীকে কথা বলতে সাহায্য করা। স্বাভাবিক কথাবার্তা ও চালচলন ব্যাহত হতে থাকলে ওষুধপত্রের পাশাপাশি আইপিটির প্রয়োগ করা যেতে পারে। রোগী যদি সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নেন তবেই দ্রুত আরোগ্যলাভ সম্ভব।
ফ্যামিলি থেরাপি
রোগী এবং তাঁর পরিবার উভয়ের মধ্যেকার সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে এই প্রক্রিয়া ব্যাবহার করা হয়। রোগীর সুস্থতার জন্যে তা জরুরি। চিকিৎসক ভাল করে বিচার করে দেখেন যে ঠিক কি কারণে পারিবারিক অশান্তি হচ্ছে যা রোগীর সাস্থের অবনতির কারণ। সেইমত তারপর সেগুলো সমাধানের চেষ্টা করা হয়। চিকিৎসক প্রথমেই রোগীর পরিবারের লোকজনকে রোগ সম্বন্ধে বোঝান। রোগের কারণে তৈরি হওয়া বিপদজনক হিংস্র আচরণ সামাল দেওয়া এবং নিজের প্রিয়জনের পাশে দাঁড়ানোর গুরুত্ব বোঝানো হয়। প্রিয়জনের সহায়তা ও রোগীর ইচ্ছা ছাড়া সুস্থতা পাওয়া অসম্ভব। দীর্ঘদিন ধরে যারা মনোরোগীর সাথে বাস করছেন, তাঁদের জন্য এই থেরাপি খুবই প্রয়োজনীয়।
শেষ কথা
আমাদের দৈনন্দিন জোবনে চলাফেরার পথে বা আমাদের জীবনের যুদ্ধে অনেক রকম মানষিক রোগ এ আমরা ভুগে থাকি। এটাও কিন্তু একটা খুউব সমস্যার রোগ। চিন্তার কোনো কারণ নেই। মনে রাখবেন এই থেরাপি গুলির সঠিক ব্যবহার রোগীকে দ্রুত সারিয়ে তুলতে সাহায্য করে। ক্ষেত্র বিশেষে ওষুধ ও থেরাপি একই সাথে চালিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কোনও ক্ষেত্রে শুধু ওষুধ বা শুধু থেরাপির প্রয়োজন হয়ে থাকে। ভালো থাকবেন সুস্থ থাকবেন। ধন্যবাদ
লেখক – শান্তনু পাল