rabi ghosh comedy – হাস্যকৌতুকের আরেক রাজা রবি ঘোষ

রবি ঘোষ (১৯৩১ – ১৯৯৭) বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র অভিনেতা। বিভিন্ন ধরণের চরিত্রে অভিনয় করে বিশেষ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তবে বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে তিনি সবচেয়ে পরিচিত তার হাস্যরসাত্মক চরিত্র রূপায়নের জন্য বিশেষ ভাবে পরিচিত। সত্যজিৎ রায়ের চলচ্চিত্রে তাকে নিয়মিত অভিনয় করতে দেখা গেছে। চলচ্চিত্র ছাড়াও তিনি বাংলা নাট্যমঞ্চ এবং টেলিভিশন তথা ছোট পর্দায় অভিনয় করেছেন। সত্যজিৎ রায় পরিচালিত গুপী গাইন বাঘা বাইন চলচ্চিত্রে বাঘা চরিত্রে অভিনয় করার জন্য তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে আছেন।বাংলা চলচিত্রের নবজাগরণের এক অন্যতম চির স্মরণীয় অভিনেতা রবি ঘোষ। শুধুমাত্র হাস্যকৌতুকের জন্যই যে চিরপরিচিত ছিলেন তা নয়, বরঞ্চ সর্বরকমের অভিনয়ের পারদর্শিতার শিখর ছুঁয়ে ছিলেন। তিনি ২৪শে নভেম্বর, ১৯৩১ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। ১৯৪৯ সালে তিনি সাউথ সুবর্ধন মেইন স্কুলথেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ইন্টারপাস করে তিনি আশুতোষ কলেজ-এ ভর্তি হন, গ্রাজ্যুয়েশনের জন্য। ১৯৫৩ সাল থেকে ১৯৫৯ পর্যন্ত তিনি ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কাজ করেন। তিনি অভিনেত্রী অনুভা গুপ্তকে বিয়ে করেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর দশ বছর পর তিনি ২৪শে নভেম্বর, ১৯৮২ সালে বৈশাখী দেবীকে বিয়ে করেন। রবি ঘোষ উচ্চতায় খাটো হলেও তার অভিনয়ের দক্ষতায় এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যান তিনি। তথাকথিত সুপুরুষ হিসেবে বিবেচিত না হলেও রুপালি পর্দায় তার নিজ স্মরণীয় উপস্থিতি সকলের মন আজও জড়িয়ে আছে। রবি ঘোষের অভিনয়ের বৈশিষ্ঠতাই ছিল হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক রূঢ় বাস্তবিক ঘটনাগুলিকে দর্শক কুলের সামনে উপস্থাপন করা। তৎকালীন তার মতো স্বকীয় অভিনেতা জুড়ি মেলা ভার। তার অভিনয়ের আন্তরিকতা ও সংবেদহনশীলতা প্রতিটি চরিত্র কে নিজ নিজ আঙ্গিকে নিজ নিজ রূপ প্রদান করেন, আর এই জন্যেই রবি ঘোষ হাস্যরসের দুনিয়ায় এক নতুন স্বরলিপি তৈরী করে যান। রবি ঘোষ সেই সাত এর দশক থেকে আজও  আট থেকে আসি সকলের পরিচিত। নিচে তার অসাধারণ কিছু ছায়াছবি।

1.গল্প হলেও সত্যি

তপন সিনহা পরিচালিত গল্প হলেও  সত্যি বাংলা মজার ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। যার মুখ্য চরিত্রে ছিলেন বাংলার প্রবাদ প্রতিম চিত্রভিনেতা রবি ঘোষ। এই ছবিটি  ভারতীয় চলচিত্রে সারা ফেলে দিয়েছিলো। রবি ঘোষ এই চলচিত্রের মাধ্যমে এক অন্যতম অভিনেতার আসনে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। হাস্য রসের পরিপূর্ণ এই ছবিটিতে তৎকালীন সমাজের একান্ন বর্তী পরিবারের সু ও কেউ গুন্ গুলো হাসির মোড়কে আমাদের সামনে তুলে ধরা হয়েছিল না, আর এই কাজ এ অভিনেতা রবি ঘোষ যথোপযুক্ত ভাবে নিজেকে সঠিক উঁচুতে নিয়ে গিয়েছিলেন।

2. অরণ্যের দিনরাত্রি

১৯৭০ সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত ও রবি ঘোষ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সমিত ভঞ্জ,শর্মিলা ঠাকুর, সিমি গাড়োয়াল ও আরও বিশিষ্ট অভিনেতা  নিয়ে মুক্তি পায় অরণ্যের দিনরাত্রি। এই ছবিতে রবি ঘোষ একটি সোহো অভিনেতার চরিত্রে অভিনয় করলেও তার অসীম অভিনয় ক্ষমতার দক্ষতা দর্শক কুলের খুউব সহজেই নজর করে। রবি ঘোষ এইখানে এক বিশেষ বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করে। সমগ্র ছবিতে তার অভিনয়ের মুন্সিয়ানা,বিশিষ্ট পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের ও মন কাড়ে।

3. গুপী গায়েন বাঘা বায়েন

১৯৬৮ সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত এক কালজয়ী বাংলা ছবি গুপী গায়েন বাঘা বায়েন মুক্তি পায়। যার বিশিষ্ট চরিত্রে অভিনয় করেন রবি ঘোষ, তপন চট্টোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্ত ও আরও অনেকে। রবি ঘোষ এই ছবিতে বাঘা নাম এ এক অশিক্ষিত ঢোল বাদক এর ভূমিকায় অভিনয় করেন। এই চরিত্র রূপায়ণের রবি ঘোষ এক  উৎকর্ষতায় নিজেকে নিয়ে যায়। তার সাবলীল  অভিনয়ের ভঙ্গিমা আজও সকলের মন কাড়ে। লেখা পড়া না জেনে কিভাবে এক মানুষ সামাজিকতার দায়বদ্ধতাকে নিজের করে নিয়ে সমাজ সংস্কারে এগিয়ে যেতে পারে তাই এই চরিত্রের মাধ্যমে হাস্যকৌতুক মিশিয়ে নিজেকে দর্শক কুলের কাছে তুলে ধরেছিলেন রবি ঘোষ। আর এখানেই তার বৈশিষ্ট আমরা লক্ষ্য করতে পারি, যা আজও সকলের  মনে আছে।

4. হীরক রাজার দেশে

১৯৮০ সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত  হীরক রাজার দেশে  ছবিটি মুক্তি পায়, যার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রবি ঘোষ তপেন  চট্টোপাধ্যায় উৎপল দত্ত ও আরও অনেকে। এই ছবিতে বিশ্ব বিখ্যাত পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সাথে সমান ভাবে দক্ষতা দেখিয়েছিলেন প্রবাদ প্রতিম চিত্রভিনেতা রবি ঘোষ। এই ছবিতে রবি ঘোষ বাঘা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং হাসির কৌতুকের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজের রাজনৈতিক পেক্ষাপট সুষ্ঠভাবে বর্ণনা করতে পরিচালক সত্যজিত রায়ের সাথে সঠিকভাবে  গাঁটছড়া বাঁধতে তিনি পেরেছিলেন, যা আজও ভারতীয় সিনেমার এক অমূল্য সম্পদ রূপে বিবেচিত হয়।

5. গুপী বাঘা ফিরে এলো

১৯৯১ সালে সত্যজিৎ রায়ের সুযোগ্য পুত্র সন্দীপ রায়ের পরিচালিত গুপী বাঘ্য ফিরে এলো ছবিটি মুক্তি পায়। এই ছবিতে রবি ঘোষ খুবই পরিণত ও মুন্সিয়ানার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করেন। হাস্যরসের সমৃদ্ধ এক চরিত্রের মাধ্যমে এক অসামান্য চরিত্র  শিল্পী হয়ে ওঠেন আমাদের বাংলা সিনেমার দর্শক কুলের মাঝে। এটি তার জীবনের বাঘা চরিত্রের অন্তিম প্রকাশ কারণ এই ছবির পর  থেকে তিনি আর বাঘা চরিত্রে অভিনয় করেননি। কারণ এর কয়েক বছর উনি পরলোক গমন করেন।

6. বসন্ত বিলাপ 

১৯৭৩ সালে দীনেন গুপ্ত পরিচালিত বসন্ত বিলাপ ছবিটি মুক্তি পায়। যে ছবিতে রবি ঘোষ এক বিশেষ পার্শ  চরিত্রের অভিনয় করেন তার অভিনয় সাবলীল ও হাস্যরসের ভরপুর যা ওই সিনেমাতে এক অন্য মাত্রা যোগ করেন। পার্শ চরিত্র হওয়া সত্ত্বেও রবি ঘোষ নিজের অভিনয়ের জোরে আজ সকলের মনের মনিকোঠায় জীবিত রাখতে পেরেছেন।

7.মর্জিনা আব্দুল্লা

১৯৭৩ সালে দীনেন গুপ্ত পরিচালিত মর্জিনা আব্দুল্লা ছবিটি মুক্তি পায়। যার মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রবি ঘোষ। এই চরিত্রে তিনি এক অশিক্ষিত ধূর্ত ভিত্তের অভিনয় করেন। হাস্যকৌতুকে ভরা এই অভিনয় আট থেকে আশি আজও সকলের মন জুড়ে আছে। এই ছবির মাধ্যমে সামাজিক সম্পর্কের অবক্ষয়ের দিকগুলি হাসো রসের মাধ্যমে আমাদের সামনে উপস্থাপনা করেছিলেন দীনেন গুপ্ত আর তারই সাথে সমান ভাবে সাহায্য কোরেছিলেন বিশিষ্ঠ হাস্যকৌতুক অভিনেতা রবি ঘোষ, যার অভিনয় দক্ষতা বলে দেয় বাংলা চলচিত্রের স্বর্ণ যুগের রূপকার কে।

শেষ কথা 

রবি ঘোষ বিখ্যাত ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র একজন অভিনেতা। যার অভিনয়ে তিনি আজও অমর। সারা বাংলা জুড়ে তিনি সারাটা জীবন সবার কাছে যেমন প্রিয় ছিলেন আজও আছেন আর ভবিষ্যতে সারাটা জীবন সেই অমর থাকবেন। তার শারীরিক উচ্চতা হয়তো বেশি ছিল না। কিন্তু তার কাজ, তার অভিনয় এবং বলাই বাহুল্য তার মঞ্চস্থ অভিনয়ও আমাদের মনে আজও সারা দেয়। তাই আজ এই শেষ কথায় বলি রবি দা তোমায় আজও মনে পরে। হয়তো তোমার মতন আর কাউকেই পাবো না। যেখানেই থাকবেন ভালো থাকুন। আর বাংলা চলচিত্রকে আশীর্বাদ করুন যাতে আগামী দিনেও বাংলা চলচিত্র আরও সাফল্য পায়। ধন্যবাদ।

লেখক – শান্তনু পাল