ভারতীয় চলচিত্রের স্বর্ণযুগের সূচনা কালের অন্যতম সংগ্রামী সৈনিকদলের মধ্যে যাদের স্থান অগ্রগণ্য বাংলা চলচিত্র। ভারতীয় চলচিত্রে বাংলা চলচিত্রের অবদান অপরিসীম ও অপরিমেয়। যা কখনোই আমরা অবহেলা করতে পারিনা। ভারতীয় আধুনিক চলচিত্রের রূপকার প্রমথেশ বড়ুয়া, যাঁর অবদান অরসিক কার্য। আধুনিক ভারতে বর্ণময় চলচিত্রের সূচনা লগ্নে প্রতিষ্ঠাতা প্রমথেশ বড়ুয়া, বিমল কর, ঋত্বিক ঘটক, অরবিন্দ মুখার্জী, সত্যজিৎ রায়, সত্যেন বোস, চিদানন্দ দাসগুপ্ত,ইত্যাদি প্রমুখদের সহায়তায় বাংলা চলচিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় চলচিত্রের এক উচ্ছমার্গে পৌঁছেছিল। ভারতীয় চলচিত্রের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আরও পাই স্বর্ণযুগের সূচনা লগ্নের অমূল্য কিছু বাংলা সংস্কৃতি ঐতিহ্য ও সংগীত, যা বিশ্ব দরবারে ভারতীয় চলচিত্রের মাধ্যমে আধুনিক নবজাগরণের পৃথিবীতে বাংলা সংস্কৃতি পায় এক নতুন নাম। স্বর্ণ যুগের বাংলা চলচিত্রের মধ্যে আমরা পাই মাটির গন্ধ, আধুনিকতার চাকচিক্য, পাই প্রাণের স্পন্ধন। যা বাংলা চলচিত্রকে ভারতীয় চলচিত্র মাঝে এক নতুন ঠিকানা করে দিতে পেরেছে। এযাবৎ কালীন অন্যতম মহানায়ক আমরা পেয়েছি বাংলা চলচিত্রের মাধ্যমে। উত্তম কুমার ভারতীয় চলচিত্রের প্রথম মহানায়ক। যার মাধ্যমে আমরা চিনতে পারি বাঙালির ঐকান্ট্রিক বৈশিষ্ট সমূহ। বাঙালি স্বর্ণ যুগের বাংলা চলচিত্রের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছিলো তার সর্বভারতীয় অস্তিত্ব। যার রুপুকার, ছবি বিশ্বাস, প্রমথেশ বড়ুয়া, মলিনা দেবী, ছায়া দেবী, পদ্মা দেবী, অনুভা গুপ্ত, উত্তম কুমার, ও বহুল প্রচলিত সুচিত্রা সেন ও আরও অনেকে। বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় জুটি আমরা প্রথম পাই উত্তম সুচিত্রা। যা বাঙালিকে ভাবতে শেখায় আধুনিক প্রেমের নতুন সমীকরণ যা সর্বকালীন, ভারত প্রসিদ্ধ,তৎকালীন স্বর্ণযুগের বাংলা সিনেমাতে আমরা দেখতে পাই সমকালীন সমাজ-ব্যাবস্থার এক সুনিপুন চিত্রপট। যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি তৎকালীন আপামর বাঙালির দৈনন্দিন জীবন ঠিক তেমনি বুঝতে পারি সমাজের ওপর তোলার ধোনি বাঙালির জীবন কুশলও আর এখানে তৎকালীন প্রাচীন স্বর্ণযুগের বাংলা সিনেমা আর বৈশিষ্টতা। যা আজ আমাদের মতো অনেক দর্শক কুলকে মুখ্যদা করে রেখেছে। আর একটি অন্যতম বিষয় হলো তৎকালীন বাংলা ছবির সংগীত ও বাদ্য যন্ত্র, যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি স্বর্ণযুগের বাঙালির মনের সংগীত অনুরাগ ও নিষ্ঠা, যা আমাদের ভারতীয় সংস্কিতির আজ বহন করে নিয়ে চলেছে। সেই যুগে বাংলা সিনেমাতে আমরা দেখতে পাই সঠিক চরিত্রের চরিত্রায়ন। মুখ্য চরিত্র থেকে পার্শ চরিত্র সকলেই নিজ নিজ জায়গাতে সঠিক ভাবে রূপায়নের জন্যে আজ প্রশংসিত। যা বাংলা চলচিত্রকে ভারতীয় তথা বিশ্ব দরবারে এক আলাদা পরিচয় দানের সহায়তা করে, যা সত্যি কুর্নিশ করে আজও আপামর সিনেমা প্রেমী মানুষরা।
1.প্রহ্লাদ
১৯৩১ সালে প্রিয়নাথ গঙ্গপাধ্যায়ের পরিচালিত প্রহ্লাদ ছায়াছবি টি মুক্তি পায়। এই ছায়াছবিটিতে যারা অভিনয় করেন তা হলো অহীন্দ্র চৌধুরী, জয় নারায়ণ মুখোপাধ্যায়, মৃণালকান্তি ঘোষ, ও কানন দেবী প্রমুখরা। এই ছবিতে একজন পিতার তাড়নায় এবং শিক্ষকের উপদেশে প্রহ্লাদ হরিনাম ত্যাগ না করায় হিরণ্যকশিপু তার প্রাণনাশের আদেশ দিলেন। বিষাক্ত সাপের বিষ প্রয়োগ, প্রজ্জ্বলিত আগুন, গভীর জলে ডুবানো, হাতির পদতলে পৃষ্ট হওয়াসহ ধারালো অস্ত্রের আঘাতে বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের মৃত্যু হয়নি দেখে দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে নিজ পুত্রকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুই এ সমস্ত বিপদ, সংকট হতে কিভাবে পরিত্রাণ পেলে?” প্রহ্লাদ হিরণ্যকশিপু’র প্রশ্নের উত্তরে বললেন, “সর্ববিপদভঞ্জন হরিই আমাকে এ সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেছেন”। এরপর হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোর হরি কোথায় থাকে রে?” প্রত্যুত্তরে শিশু প্রহ্লাদ বললেন, “তিনি সবসময়, সব জায়গায় অবস্থান করেন।” দৈত্যরাজ পুণরায় তাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোর হরি এক্ষণে এ স্ফটিকস্তম্ভে আছে কি?” প্রহ্লাদ উত্তর দিলেন, “আছেন বৈ-কি!” এ কথা শুনে প্রচণ্ড গর্জন করে দৈত্য হিরণ্যকশিপু ঐ স্ফটিকস্তম্ভ পা দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলেন। ঐ মূহুর্তেই তা হতে এক নরসিংহ মূর্তি নির্গত হয়ে হিরণ্যকশিপুকে স্বীয় দুই উরুর উপর রেখে দিন ও রাতের সন্ধিকালে নখ দিয়ে রক্তাক্ত করে সংহার করে।
2. পথের পাঁচালি
সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ১৯৫৫ সালে মুক্তি পায় পথের পাঁচালি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস পথের পাঁচালি অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র।অপু ত্রয়ী চলচ্চিত্র-সিরিজের প্রথম চলচ্চিত্র পথের পাঁচালীর মুখ্য চরিত্র অপুর শৈশবকে কেন্দ্র করে বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে বাংলার একটি প্রত্যন্ত গ্রামের জীবনধারা চিত্রায়িত করা হয়েছে। এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সমস্যা থাকায় নির্মাণকার্য্য ব্যাহত হয় এবং দীর্ঘ তিন বছর পরে তা সম্পূর্ণ হয়। স্বল্প বাজেটেঅপেশাদার অভিনেতা ও অনভিজ্ঞ শিল্পীদের নিয়ে এই চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। সেতার বাদক রবিশঙ্কর এই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ ব্যবহার করে চলচ্চিত্রের সঙ্গীতাবহ নির্মাণ করেন।
3. চারুলতা
১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় মুক্তি পায় চারুলতা।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় গল্প নষ্টনীড় অবলম্বনে এর চিত্রনাট্য রচিত হয়েছে। ১৯৬৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রটি ইংরেজিভাষী বিশ্বে The Lonely Wife নামে পরিচিত। সার্থক চিত্রায়নের খাতিরে এতে গল্পের কাহিনী খানিকটা পরিবর্তন করা হয়েছে। ১৮৭৯ সালের উচ্চবিত্ত এক বাঙালি পরিবারকে কেন্দ্র করে এর কাহিনী রচিত হয়েছে। পরিবারের কর্তা ভূপতি বিশুদ্ধ রাজনৈতিক চিন্তায় অনুপ্রাণিত হয়ে একটি ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তার বাড়িতেই “Sentinnel” নামে পত্রিকাটির কাজ শুরু হয়। পত্রিকার কাজে দিনরাত মগ্ন থাকায় সদ্য যৌবনে পদার্পণকারী স্ত্রীর দিকে বিশেষ মনোযোগ দেয়ার সময় পাননা। স্ত্রী চারুলতার সময় কাটে একা একা। অবসরে চারু সাহিত্য চর্চা করে সময় কাটায়। স্ত্রীর নিঃসঙ্গতা স্বাভাবিকভাবেই ভূপতির চোখে পড়ে। তাই চারুর ভাই উমাপদকে চিঠি লিখে সস্ত্রীক চলে আসার জন্য বলেন। উমাপদকে নিজের পত্রিকার ম্যানেজার নিযুক্ত করেন। উমাপদর স্ত্রী মন্দাকিনীর সাথে চারুর চরিত্রের আকাশ-পাতাল ফারাক। তাই চারুর নিঃসঙ্গতা খুব কমই প্রশমিত হয়। এমন সময় আগমন ঘটে ভূপতির পিসতুতো ভাই অমলের। দুরবিন হাতে চারুলতা অমলের সাথে চারুর সম্পর্ক আগে থেকেই বেশ ঘনিষ্ঠ। তবে প্রথম দিকে তাদের সম্পর্কে বৌঠান-ঠাকুরপোর স্বাভাবিকতা ছাড়া অন্য কিছুর ইঙ্গিত দেয়া হয়নি। ভূপতি অমলকে নিজ স্ত্রীর মধ্যে লুক্কায়িত সাহিত্যিক প্রতিভা বের করে আনার দায়িত্ব দেয়। এর সাথে তার পত্রিকার প্রুফ দেখানোর কাজে লাগানোরও চেষ্টা করে। অবশ্য সাহিত্য চর্চা ছাড়া অন্য কিছুতে অমলের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। এর মধ্যে উমাপদর মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে ভূপতি তাকে পত্রিকার আর্থিক দিকটার সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে দেয়। চারুর ভাই বলেই হয়তো উমাপদকে অবিশ্বাস করার প্রশ্ন উঠেনি। চারু অবশ্য তার ভাই সম্বন্ধে এতোটা বিশ্বাসী ছিল বলে মনে হয়না।
4. সাগিনা মাহাতো
১৯৭০ সালে তপন সিনহার পরিচালনায় মুক্তি পায় সাগিনা মাহাতো। গত শতকের সত্তর দশকে গৌরকিশোর ঘোষের কাহিনি ‘সাগিনা মাহাতো’ খুবই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল তপন সিংহের চলচ্চিত্রে এবং বাদল সরকারের প্রথম অঙ্গনমঞ্চ প্রযোজনায়। একই কাহিনির বাদল সরকারকৃত নাট্যরূপ নিয়ে আলাপের নতুন নাটক (পরিচালনা: পার্থপ্রতিম দেব) চমত্কার নাটকীয় অভিঘাতে এক ঝকঝকে প্রযোজনা। যদিও ১৯৪২-এর একটি সত্য ঘটনা নিয়ে লেখা, মূল গল্পে যে বামপন্থী রাজনীতির কড়া সমালোচনা ছিল, তা কিছুটা নিস্তেজ। তার ফলে নাটকের আবেদন বেড়েছে বই কমেনি। পরিচ্ছন্ন পরিচালনার গুণে, স্বল্প আয়োজনের মঞ্চসজ্জায়, কাহিনির অনাড়ম্বর অথচ জোরালো নাটকীয় উপস্থাপনায় এই প্রযোজনা ‘সাগিনা মাহাতো’র মঞ্চ ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
5. প্রতিদ্বন্দ্বী
প্রতিদ্বন্দ্বী ১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্র। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি এই চলচ্চিত্রে মূখ্য ভুমিকায় অভিনয় করেছেন ধৃতিমান চট্রোপ্যাধায়। এই ছবিটির অভিনয়ে ছিলেন ধৃতিমান চট্রোপ্যাধায়, কৃষ্ণা বসু, ইন্দিরা দেবী, কল্যান চৌধুরী, জয়শ্রী রায়, দেবরাজ রায়, শেফালী প্রমুখরা। এই ছবিটির জন্য সত্যজিৎ রায় ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ও পান।
6. ঘরে বাইরে
সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত ১৯৮৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ঘরে বাইরে ছায়াছবি। ঘরে বাইরে (১৯১৬) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি উপন্যাস। এটি চলিত ভাষায় লেখা রবীন্দ্রনাথের প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটি সবুজপত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত এই উপন্যাসে একদিকে আছে জাতিপ্রেম ও সংকীর্ণ স্বাদেশিকতার সমালোচনা, অন্যদিকে আছে সমাজ ও প্রথা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নারী পুরুষের সম্পর্ক; বিশেষত পরস্পরের আকর্ষণ-বিকর্ষণের বিশ্লেষণ। অভিনয়ে ছিলেন বিমল চৌধুরী,সন্দীপ মুখার্জী নিখিলেশ চৌধুরী ও অমূল্য প্রমুখরা। স্বামী নিখিলেশের প্রতি অনুরাগ সত্ত্বেও এই কাহিনীর নায়িকা বিমলা বিপ্লবী সন্দীপের দ্বারা তীব্রভাবে আকর্ষিত। একদিকে বাইরে জাতীয় আন্দোলনের উত্তেজনা অন্যদিকে তিনটি মানুষের জীবনে টানাপোড়ন – রাজনীতি ও ব্যাক্তিগত জীবনের দ্বন্দ্ব এই দুই মিলে উপন্যাস।
7. নিশিপদ্ম
১৯৭০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি বাংলা চলচ্চিত্র নিশিপদ্মা । অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় ছবিটি পরিচালনা করেন।এই চলচ্চিত্রের মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেনসাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ও উত্তম কুমার। ছবিটি বিভূতিভূষন বন্দোপাধ্যায়ের লেখা হিঙের কচুরি গ্রন্থ অবলম্বনে তৈরি করা হয়। ছবিটি ভারতের ১৮তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অনুষ্ঠানে দুইটি পুরস্কার জেতে। মান্না দে যা খুশি ওরা বলে গানের জন্য সেরা প্লেব্যাক গায়ক এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ওরে সকল সোনা মলিন হল গানের জন্য সেরা প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে পুরস্কার জেতেন।ছবিটিকে পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে হিন্দিতে পুনর্নিমাণ করা হয়। এতে শক্তি শর্মার পরিচালনায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেন শর্মিলা ঠাকুর ও রাজেশ খান্না।
8. সবার ওপরে
১৯৫৫ সালে অগ্রদূতগোষ্ঠীর পরিচালনায়মুক্তি পায় সবার ওপরে।এই ছবিটি উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, ছবি বিশ্বাস অভিনীত একটি জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র।সবার উপরে চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন রবীন চট্টোপাধ্যায় এবং গীত রচনা করেছেনগৌরীপ্রসন্ন মজুমদার।
9. সাত পাকে বাঁধা
১৯৬৩ সালে অজয় কর এর পরিচালনায় মুক্তি পায় সাত পাকে বাঁধা। সাত পাকে বাঁধা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত একটি বাংলা সিনেমা ।সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে নায়িকা সুচিত্রা সেন “সিলভার প্রাইজ ফর বেস্ট অ্যাকট্রেস” জয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় অভিনেত্রী যিনি কোনো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিলেন।
10. দেনা পাওনা
১৯৩১ সালে ‘প্রেমাঙ্কুর আতর্থী’র পরিচালিত মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা ছায়াছবি দেনা পাওনা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘দেনা-পাওনা’ উপন্যাসে ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নারীদের প্রতি অবিচার ও পণপ্রথার কদর্য্যরূপ দর্শিত হয়েছে। এই উপন্যাস অবলম্বনে ‘প্রেমাঙ্কুর আতর্থী’ ১৯৩১ সালে ‘দেনা-পাওনা’ সিনেমা তৈরি করেন। নিউ থিয়েটর্স প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রটি হিন্দি চলচ্চিত্র আলম আরার পাশাপাশি ভারতবর্ষের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র। পরবর্তীতে ‘দেনা-পাওনা’ চলচ্চিত্রটি হিন্দিতে “পূজারিন” নামে পুনর্নির্মিত হয়েছিল।
11. মেঘে ঢাকা তারা
১৯৬০ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত মেঘে ঢাকা তারা।এই ছবিটিতে অভিনয় করেছেন সুপ্রিয়া চৌধুরী,অনিল চট্টোপাধ্যায়, নিরঞ্জন রায়, গীতা ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, গীতা দে, দ্বিজু ভাওয়াল, জ্ঞানেশ মুখার্জী, রনেন রায়চৌধুরী প্রমুখরা। এই ছবিটি ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত একটি বাংলা চলচ্চিত্র। এটি হল ঋত্বিক ঘটকপরিচালিত চতুর্থ এবং প্রথম ব্যবসাসফল চলচ্চিত্র। শক্তিপদ রাজগুরুর মূল কাহিনী অবলম্বনে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখেন মৃণাল সেন। অভিনয়ে ছিলেন, সুপ্রিয়া চৌধুরী, অনিল চট্টোপাধ্যায়, নিরঞ্জন রায়, গীতা ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, গীতা দে, দ্বিজু ভাওয়াল, জ্ঞানেশ মুখার্জী, রনেন রায়চৌধুরী প্রমুখ। ১৯৭৫ সালের বার্ষিক চিত্রবীক্ষণ পত্রিকায় ঋত্বিক ঘটক জানান, দেশবিভাগের প্রেক্ষাপটে নির্মিত মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০),কোমল গান্ধার(১৯৬১) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২) এই তিনটি চলচ্চিত্র মিলে ত্রয়ী (ট্রিলজি) নির্মিত হয়েছে। ভারতে অঁতর ধারার নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটকের কাজ উল্লেখযোগ্য। সম্ভবত ঘটকের আটটি চলচ্চিত্রের মধ্যে মেঘে ঢাকা তারাসবচেয়ে বেশি পরিচিত ও আলোচিত। ঋত্বিক মারা যাবার পর, এ ছবিসহ তার অন্যান্য কাজ বিশ্বের চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে বেশি পরিচিতি পায়। সাইট অ্যান্ড সাউন্ড চলচ্চিত্র বিষয়ক মাসিক সাময়িকীতে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় এটি ২৩১ নম্বরে অবস্থান পেয়েছে।
12. দেবদাস
13. আপুর সংসার
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ১৯৫৯ সালে মুক্তি পায় আপুর সংসার ছবিটি। ছবিটিতে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, অলক চক্রবর্তী, স্বপন মুখার্জি প্রমুখরা। অপু আইএ পাশ করেছে বটে, কিন্তু চাকরী এখনও জোটাতে পারেনি, চাকরির সন্ধানে কলকাতায় ভাড়াবাড়িতে থেকে টিউশন করে সে পেট চালায়। অপুর সংসারের প্রথম দৃশ্যে অপু নিজের কলেজের এক শিক্ষকের কাছে চারিত্রিক সনদপত্র নিতে যায়। বাড়িওয়ালা বকেয়া ভাড়া চাইতে এলে তার সাথে পাক্কা শহুরে লোকের মত ঝগড়া করে অপু। নিশ্চিন্দিপুরের সেই সরল গ্রাম্য বালক এখন পুরোপুরি কলকাতার নাগরিক। বাড়িওয়ালা ভাড়া না পেয়ে তাকে তুলে দেবার হুমকি দিয়ে চলে যাবার সময় ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে গেলে অপু সেটা এবং তার সঙ্গে বাইরের আলোটাও জ্বালিয়ে দেয় – তারপর আবার নির্বিকারে দাড়ি কামানোয় মন দেয়। বহু বছর বাদে কলেজের প্রাণের বন্ধু পুলুর সাথে দেখা হয় অপুর, ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে অপুকে খাওয়ায় পুলু, চাকরির কথাও বলে। অপু বলে সে চাকরী করবে না, পরিশ্রম করবে। অপু একটা উপন্যাস লিখছে, উপন্যাসটা আসলে আত্মজীবনী – পুলুর এই মন্তব্যের প্রতিবাদ করে অপু, তার উপন্যাস কল্পনা আর বাস্তব অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণ। এর সামান্য আগেই সধবার একাদশীর সংলাপ আওড়াচ্ছিল অপু, পুলু বলে প্রেম সম্বন্ধে তার কোনও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই, তাই প্রেমের কথা সে কল্পনা করেও লিখতে পারবে না। অপু পুলুর সাথে তর্ক করে চলে – যদিও তার যে প্রতিবেশিনী রোজ তার বাঁশি শোনার জন্য জানালার ধারে এসে দাঁড়ায়, অপু তাকে দেখে লুকিয়ে পড়ে। পুলু অপুকে নিমন্ত্রণ কোরে তার মাসির মেয়ের বিয়েতে নিয়ে গেলে ঘটনাচক্রে অপর্ণাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয় অপু, বিয়ের আগে পুলুকে যে চাকরিটা নেবে না বলেছিল সেটার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নেয়।অপর্ণাও শহুরে দরিদ্র জীবনে দরিদ্র স্বামীর ভাড়াবাড়ির সংসারে মানিয়ে নেয়। স্বামী অফিস থেকে ফিরলে তার সঙ্গে মস্করা করে কাগজের ঠোঙা ফাটিয়ে, সিগারেটের প্যাকেটে অণুরধ লিখে রাখে সিগারেট না খাবার, বাড়িতে কাজের লোক না রাখতে চেয়ে অপুকে অণুরধ করে বাড়তি টিউশনগুলো ছেড়ে দেবার, আবার অপর্ণা খেতে বসলে অপু পাসে বসে তাকে বাতাস করে। কাজলের জন্ম দিতে মৃত্যু হয় অপর্ণার। প্রচণ্ড মানসিক আঘাতে বিপর্যস্ত অপু আত্মহত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না – অপু আবার বোহেমিয়ান হয়ে পড়ে। কাজলকে অপু পছন্দ করে না, কারণ কাজল আছে বলেই অপর্ণা নেই। চাকরদের কাছে মানুষ হবার ফলে মাতৃস্নেহ বঞ্চিত ছেলেটা অত্যন্ত অবাধ্য। তার কাছে কলকাতা এবং বাবা এই দুটো কথাই প্রায় সমার্থক, কারণ তাকে বলা হয়েছে তার বাবা কলকাতায় থাকে এবং দুটোই তার কাছে অদেখা। অপু বাবা হিসাবে কাজলকে ধরতে গেলে কাজল ঢিল ছুড়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়, কিন্তু সে যখন বলে সে কাজলের বন্ধু এবং তাকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চায়, তখন কাজল রাজি হয়। এইভাবে জৈবিক সম্পর্কের সীমানা ছাড়িয়ে মানবিক / সামাজিক সম্পর্ককে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা। অপুর সংসারের শেষ দৃশ্য – অপুর কাঁধে চেপে কাজল চলেছে কলকাতায়।
14.অমর সঙ্গী
১৯৮৭ সালে সুজিত গুহের পরিচালনায় মুক্তি পায় .অমর সঙ্গী। চলচ্চিত্রটিতে প্রধান ভূমিকা অভিনয় করছিলেন প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় এবং বিজয়েতা পন্ডিত। বাপী লাহিড়ীএই সিনেমার গানগুলো রচনা করেছেন। এটি ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে বৃহত্তম ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্রের অন্যতম। বিশেষ করে ছবিটি জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সঙ্গীতের জন্য । কিশোর কুমার এর গাওয়া চিরদিনি তুমি যে আমার গানটি আজও বিখ্যাত হয়ে আছে। এই চলচ্চিত্রের পর প্রসেনজিতের ক্যারিয়ার রাতারাতি জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় এবং বর্তমানে তাকে এই শিল্পে কিংবদন্তী অভিনেতা হিসেবে ধরা হয়
15. উনিশে এপ্রিল
১৯৯৪ সালে ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালিত উনিশে এপ্রিল।এই ছবিটিতে অভিনয় করেন অপর্ণা সেন,দেবশ্রী রায়, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে,সুদেষ্ণা রায়, চিত্র সেন প্রমুখরা। ১৯৯৪ থেকে ২০১৩, মাত্র ১৯ বছর। এর মধ্যেই ঋতুপর্ণ ঘোষের মেধা এবং প্রতিভার ফসল মোট ১৯টি ছবি। প্রত্যেকটি ছবিই সতন্ত্র,অনবদ্য। ১৯টি ছবির মধ্যে ১২টি জাতীয় পুরষ্কার জয় করেছিল। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক পরবর্তী বাংলা সিনেমার নতুন এক ধারা তৈরি করেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ১৯৯৪ সালের ঠিক এই দিনেই বাংলা ছায়াছবির নতুন বাঁকবদল ঘটেছিল। এই দিনটি ঘিরেই তৈরি হয়েছিল প্রয়াত পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের প্রথম ছবি। নাচ-গান না রেখেও, আউটডোর শ্যুট না করেও যে একটি সফল বাণিজ্যিক ছবি করা যেতে পারে-সেটাই যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছিলেন পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। ব্যস! জুটে গেল জাতীয় পুরস্কার। বাংলা ছয়াছবির নবজাগরণ ঘটেছিল এই উনিশে এপ্রিল ছবির হাত ধরে-একথা বললে অত্যুক্তি করা হবে না। অনেক চরিত্রের ভিড় নেই৷ বদলে হাতে গোনা কিছু চরিত্র স্থান পেয়েছিল এই ছবিতে।
শেষ কথা
রুপোলি পর্দা আমাদের মানবিক মনের বাস্তবিক ও কল্পনিক চিন্তা ভাবনা কে এক এক করে অন্য মাত্রা তৈরী করে যা আমাদের মানবিক মনে এক স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ যেমন তৈরী করে ঠিক তেমনি না পাওয়ার কষ্ট কে কম করতে সহায়তা করে। সিনেমা আমাদের মনে এক নতুন চিন্তা ভাবনা করার অবকাশ করে দেয়। যা আমাদের মানবিক মনের এক নতুন উৎকর্ষতার সৃষ্টি করে। আর এখানেই সমকালীন স্বর্ণযুগের প্রাচীন বাংলা ছবির স্বমহিময় আজও বিদ্যমান। যা ভারতীয় সিনেমাতে জাতীয় শাস্ত্রে এক প্রকার নিজস্বতা তৈরী করতে সফল হয়েছিল বাংলা সিনেমা। আর এই ধারা বয়ে নিয়ে সর্ব ভারতীয় শাস্ত্রে নিজেদের বৈশিষ্ঠতা আজও ধরে রাখতে সক্ষম বাংলা সিনেমা। স্বর্ণযুগের বাংলা সিনেমা সেই ধারা আজও সমহিময় বিদ্যমান ও নিজ গতিতে ধাবমান।