কিডনি রোগের প্রতিকার – Kidney Disease Symptoms in Bangla

কিডনি শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ। এর কোনো সমস্যা হলে যেমন ভয়ের কারণ রয়েছে, তেমনি চিকিৎসার মাধ্যমেও কিডনির রোগ নিরাময় করা সম্ভব।  বর্তমানে আমাদের দেশে কিডনি রোগীর সংখ্যা খুবই দ্রুতগতিতে বাড়ছে, যা আমাদের সাধারণ মানুষের মনে বেশ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। তাই এ রোগের ব্যাপারে জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। সবার প্রথমে আমাদের জানা প্রয়োজন যে কিডনি কি বা এর কাজ কি ?

একঝলকে দেখে নেওয়া যাক hide

কিডনির কি এবং তার  কাজ কি 

কিডনি আমাদের শরীরের অতি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্রত্যেক মানুষের শরীরে দুটি করে কিডনি থাকে। এর আকার খুব বড় নয় কিন্তু এর কাজ অনেক ব্যাপক। যেমন- -কিডনি আমাদের শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দেয়। কিডনি অকেজো হলে শরীরে দূষিত পদার্থ জমে যায় ফলে নানান উপসর্গ দেখা দেয়। -কিডনি গুরুত্বপূর্ণ হরমোন তৈরি করে যা শরীরের অন্যান্য ফাংশন নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা, শরীরে রক্ত তৈরি করা। তাই কিডনি অকেজো হলে শরীরে রক্তশূন্যতা দেখা দেয় এবং রক্তচাপ বেড়ে যায়। -কিডনি আমাদের শরীরে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ এবং ইলেক্ট্রোলাইট (ক্যালসিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম)-এর সমতা রক্ষা করে। কিডনি কাজ না করলে পটাশিয়ামের মাত্রা বেড়ে যায় যেটা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।

কিডনি রোগের লক্ষন কি কি

কিডনি রোগ নানান ধরনের হয়ে থাকে এবং এর লক্ষণসমূহ নির্ভর করে রোগের ধরনের ওপর। যেমন- কিডনির ইনফেকশন হলে সাধারণত জ্বর আসে। কোমরের পেছনে ব্যথা হয় এবং প্রস্রাবে জ্বালাও হতে পারে। তাছাড়া অল্প বা অতিরিক্ত প্রস্রাব হওয়া, প্রস্রাবে রক্ত যাওয়া। শরীর ফুলে যাওয়া, দুর্বল লাগা, উচ্চ রক্তচাপ, শ্বাসকষ্ট, খাবারের অরুচি, বমি বমি ভাব, ওজন কমে যাওয়া, শরীরে চুলকানি এর সবই কিডনি রোগের লক্ষণ হতে পারে। তবে অনেক সময় প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগের কোনও লক্ষণ না-ও থাকতে পারে এবং এটা শুধু পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমেই ধরা পড়ে।

কিডনি রোগের ধরন ও তার প্রতিকার

কিডনি রোগ সাধারণত দুই বার হয়ে থাকে  1) একিউট কিডনি ইনজুরি (একেআই) এবং 2) ক্রনিক কিডনি ডিজিস (সিকেডি)। যেসব রোগী হঠাৎ করে কিডনি রোগে আক্রান্ত হন তাদের আমরা একিউট কিডনি ইনজুরি বলে থাকি। সময়মতো যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে এ রোগের পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব। যেসব কারণে একিউট কিডনি ইনজুরি হয়ে থাকে, তাদের মধ্যে অন্যতম কারণগুলো হলো- 1) ডায়রিয়ার মাধ্যমে শরীরে পানিশূন্যতা 2) যে কোনও কারণে শরীর থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়া 3) সেপটিক শক 4) ভলটারিন জাতীয় ব্যথার ঔষধ এবং এমাইনোগ্লাইকোসাইড জাতীয় এন্টিবায়োটিক সেবন ইত্যাদি। এ রোগে আক্রান্ত রোগীদের অনেক সময় সাময়িক ডায়ালাইসিসও লাগতে পারে কিন্তু পরবর্তীতে তাদের কিডনি পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। যেসব কিডনি রোগ ধীরে ধীরে (মাস বা বছরের মধ্যে) কিডনির ক্ষতি করে তাদের ক্রনিক কিডনি ডিজিস বলা হয়। দীর্ঘদিন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ অথবা গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস থাকার কারণে ক্রনিক কিডনি ডিজিস হতে পারে। এ রোগে আক্রান্ত রোগীরা নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন কিন্তু তাদের কিডনি পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে না। একপর্যায়ে তাদের নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে ভালো থাকতে হয়। এ চিকিৎসার মাধ্যমে রোগীরা পুরোপুরি সুস্থ জীবন যাপন করতে পারেন, যদিও চিকিৎসা একটু ব্যয়বহুল। সাপ্তাহিক: কিডনি রোগ কি প্রতিরোধ করা সম্ভব? ডা. ফাহমিদা বেগম: হ্যাঁ, অনেক কিডনি রোগই প্রতিরোধ করা যায়। যাদের ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপ আছে তারা যদি নিয়মিত চিকিৎসার মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণে রাখেন তাহলে কিন্তু কিডনি রোগ অনেকাংশে এড়ানো যায়। আবার কিছু কিছু কিডনি রোগ হয় অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে, যেমন আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই কিছু না কিছু জয়েন্ট পেইন থাকে, যার বেশিরভাগই বিভিন্ন ব্যায়াম এবং ফিজিওথেরাপির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কিন্তু, আমরা অনেকেই তা করি না। এমন অনেক লোক আছেন, যারা মাসের পর মাস ব্যথার ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন। এটাও কিডনি ফেইলিওরের একটি অন্যতম কারণ। আজকাল যেটি বেশি ভয়ের কারণ সেটি হচ্ছে, কেমিকেলযুক্ত খাবার। আমরা যা-ই খাই না কেন, তা রক্তের মাধ্যমে কিডনিতে গিয়ে পৌঁছায় এবং কিডনি তা ফিল্টার করে। এইসব দূষিত পদার্থ ফিল্টার করতে করতে একসময় বেচারা কিডনি নিজেই দুর্বল হয়ে যায়।

সাধারণত কিডনির কোন কোন রোগে মানুষ বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে?

উত্তর : কিডনি রোগকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করি। যেটা হঠাৎ করে কিডনি আক্রান্ত করে তার নাম হলো, একিউট কিডনি রোগ। আর যেটা ধীরে ধীরে কিডনিকে আক্রান্ত করে তাকে বলা হয় ক্রনিক কিডনি রোগ।  দুটোই নিরাময় করা সম্ভব। এত ভয়ের ব্যাপারও যেমন থাকে, আশার ব্যাপারও তেমন রয়েছে।

একিউট ও ক্রনিক এই দুই রকম কিডনি জনিত সমস্যা হয় 

একিউট কিডনি :- 

রোগটি হঠাৎ করে কিছু বোঝার আগেই হয়ে যায়। কিডনি আমাদের শরীরের আবর্জনাগুলো পরিষ্কার করে, প্রস্রাবের মাধ্যমে। একিউট কিডনি রোগের প্রধান উপসর্গই হলো প্রস্রাব কমে যাওয়া। অনেক ক্ষেত্রে প্রস্রাব কমতে কমতে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর এর সঙ্গে চোখ বা চোখের পাতার নিচে  মুখমণ্ডল ফুলে যেতে পারে। পায়ে পানি আসতে পারে। সঙ্গে বমি বমি ভাব, এমনকি বমি হয়েও যেতে পারে। এটাকে আমরা বলি তাৎক্ষণিক কিডনি রোগের উপসর্গ। এ ছাড়া আপনি হয়তো সুস্থ আছেন, হঠাৎ কোনো কারণে ডায়ারিয়াজনিত রোগ হলো, বারবার বমি করতে থাকলেন। সে ক্ষেত্রে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা হলেও একিউট কিডনি রোগ হতে পারে।

এ ছাড়া নারীর ক্ষেত্রে প্রসবকালীন যদি জটিলতা হয়, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, রক্তচাপ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায় বা কমে যায়, ইনফেকশন হয় তাহলেও একিউট কিডনি রোগ বা একিউট কিডনি ফেইলিউর হতে পারে।

এ ছাড়া আমরা তো অনেক সময় জ্বরে ভুগি, চিকিৎসক হয়তো অ্যান্টিবায়োটিক দিল, সে হয়তো জানে না ব্যক্তির সুপ্ত কিডনি রোগ আছে। এই অ্যান্টিবায়োটিকের ফলে একিউট কিডনি রোগ হতে পারে।

এ ছাড়া কেউ যদি সড়ক দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়, অথবা কোনো অস্ত্রোপচারের পরে যদি রক্তক্ষরণ হয় অথবা হঠাৎ শরীরের কোনো অংশ পুড়ে যায়, যদি ৪০ শতাংশের ওপর পুড়ে যায় তখন একিউট কিডনি ফেইলিউর হতে পারে।

ক্রনিকের ক্ষেত্রে :-

ক্রনিকের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ আমরা কিডনি রোগ পাই ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ। অথবা উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনি রোগ। অথবা নেফ্রাইটিক সিনড্রম যেটা বলি সেই ধরনের কিডনি রোগ। এটাই সাধারণত প্রধান কিডনি রোগ, যা ক্রনিক হয়ে আসে। ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই তিনটি বিষয়ই ক্রনিক কিডনি রোগের কারণ হয়ে থাকে।

ক্রনিক কিডনি হওয়ার কারণ 

যদি ডায়াবেটিস হয় তখন দেখা যায়, রক্তে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। এই শর্করা বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি করে। এর ফলে কিডনির যে ছাকনি বা ফিল্টারিং পার্টগুলো, দুটো কিডনিতেই তো লাখ লাখ ছাঁকনি রয়েছে, সেগুলো আক্রান্ত হয়। আর এগুলো আক্রান্ত হওয়ার জন্য আমাদের শরীর থেকে যে অ্যালবুমিন এটি নির্গত হয়। যখন থেকে ডায়াবেটিস রোগীর প্রস্রাব দিয়ে অ্যালবুমিন নির্গত হয়, তখন আমরা বুঝতে পারি তার ডায়াবেটিস থেকে কিডনি রোগ হয়েছে। ঠিক তেমনি উচ্চ রক্তচাপের কারণে কিডনির যে ছাঁকনি সেখানে চাপ দিয়ে থাকে। এই চাপের কারণে ছাকনির ভেতর রক্তনালিগুলো আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত হওয়ার জন্য আবার সেই রক্তনালি দিয়ে অ্যালবুমিন যেতে থাকে। কোনো কিডনি রোগ ধরতে হলে, হয়তো তার প্রস্রাবে অ্যালবুমিন যাবে অথবা তার লোহিত কণিকা বা শ্বেতকণিকা যেটা থাকবে সেটা যাবে। সে জন্য আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি বুঝতে পারি অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না এটা দেখে।

একিউট ও ক্রনিক  দুটোর প্রতিকার

একিউট কিডনি:-  যদি একিউট কিডনি রোগ হয় তবে কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা দিতে হবে। আমরা প্রথমেই রোগ নির্ণয় করার জন্য তার রক্তে ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন এবং ইলেকট্রোলাইটটা করে থাকি। যদি দেখা যায়, ডায়রিয়া এবং বমির জন্য তার একিউট কিডনি রোগ হয়েছে, শরীরে পানিশূন্যতা এসে গেছে তখন স্যালাইন দিয়ে চিকিৎসা করি, পটাশিয়াম দিয়ে চিকিৎসা করি। এরপর রক্তচাপ যদি কম থাকে, সেটি স্বাভাবিক করে দিই। এগুলো করলে ব্যক্তি পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে যায়। তার জন্য অবশ্যই তাকে চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে। আর পানিশূন্যতা হলে বুঝতে হবে, এটি রোধে কী করবে। গ্রামগঞ্জে থাকলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে আমরা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট খেতে বলি। আর বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ওরাল রিহাইড্রেশন সল্টের সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন খেতে বলি। সুতরাং এখানে অ্যান্টিবায়োটিকের গুরুত্ব যতটুকু, তার তুলনায় ব্যক্তির শরীরে যে পানিস্বল্পতা হয়েছে এটি ঠিক করার গুরুত্ব বেশি। হঠাৎ যদি তার চোখে পানি এসে যায়, প্রস্রাব দিয়ে অ্যালবুমিন বেড়িয়ে যায় সেক্ষেত্রে আমরা রোগীর কিডনি বায়োপসি করে দেখি যে কী ধরনের কিডনি রোগ হচ্ছে। এর যথাযথ চিকিৎসা করলে সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়। শিশুদের ক্ষেত্রে শতকরা ৯০ ভাগ রোগী সুস্থ হয়ে যায়। আর বড়দের ক্ষেত্রে বায়োপসির প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসা করি তবে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ রোগী পুরোপুরি ভালো হয়ে যায়। বাকিগুলো ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হবে। সুতরাং এগুলোর ক্ষেত্রে কিডনি অকেজো হওয়ার আশঙ্কা কম।

আর একিউট কিডনি রোগ অন্যান্য যে কারণে হয়, যেমন সার্জারির কারণে যদি হয় সেটা কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক দিচ্ছে এর পরিমাণ কী রকম হবে সেটা নির্ণয় করে বা অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দিয়ে  একিউট কিডনি রোগ চিকিৎসা করা হয়।

ক্রনিক কিডনি:- আর ক্রনিক কিডনি রোগের ক্ষেত্রে আমরা যেটা বলে থাকি, যখনই তার প্রস্রাব দিয়ে মাইক্রো-অ্যালবুমিন যাবে, তখন কিডনির কার্যক্রম সে অবস্থায় স্বাভাবিক থাকে। এই মাইক্রো-অ্যালবুমিনের প্রতিকার করার জন্য বিভিন্ন ওষুধ আজকাল আবিষ্কার করা হয়েছে। সেটা দিলে বৃদ্ধিটা বন্ধ হবে। তাকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করেই সুস্থ থাকতে হবে। উচ্চ রক্তচাপের জন্যও তাই। এ ছাড়া অবশ্যই ফলোআপে জন্য তিন থেকে ছয় মাস পরপর চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।

শেষ কথা 

কোনো রোগই ছোট মনে করা উচিত নয়। সেটা সামান্য হোক বা কোনো ক্ষত হয়ে যাওয়া শরীরের কোনো জায়গা হোক। মনে রাখবেন নিরোগই  রাখবে আপনাকে অনেক মানুষিক ও শারীরিক সুস্থ। ওপারের উল্লেখ করা কিডনির কারণ গুলোর মধ্যে যদি একটাও দেখতে পান তাহলে সরাসরি ডাক্তার এর সাথে আলোচনা করুন বা হাসপাতালেও গিয়ে দেখতে পারেন। মানব দেহের মধ্যে এক অন্যতম হলো কিডনি। আমাদের দেহের মধ্যে দুটি কিডনির মধ্যে যাতে একটিও খারাপ না হয় সে দিকটা সচেতন হতে হবে। ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন ও  সুস্থ রাখুন। আর হ্যা শেয়ার করতে ভুলবেন না। শেয়ার করে সবাইকে সাহায্য করে দিন পড়ার বা দেখার জন্য। কে বলতে পারে আপনার একটি শেয়ার এর জন্য হয়তো কারোর ভালো হবে। ভালো থাকেনবেন। ধন্যবাদ।