সত্যজিৎ রায় রচনা ও অনুচ্ছেদ – Satyajit Ray Essay & Paragraph


ভূমিকা:

সত্যজিৎ রায় বাংলা জগতে শুধু একটা নাম না। বাঙালীজীবনে একটা আবেগের নাম সত্যজিৎ রায়। সিনেমা ও তার বানিজ্য এই নিয়ে ভারতকে যদি বিশ্বদরবারে কেউ রেখে থাকেন তাঁর নাম সত্যজিৎ রায়। রেনেসাঁ যুগের মানুষ তিনি নন। কিন্তু তাঁর হাতেই ভারতীয় চলচিত্র নিজের স্বাবলম্বী ভাষা পেয়েছিল। মানুষের  মনন তাঁর সিনেমাতে প্রাধান্য পেত। প্রথম জীবনের বিখ্যাত অ্যাড ফিল্ম মেকার তাঁর বানিজ্যিক শিল্পের প্রতি টানকে প্রতিষ্ঠা করেন। পরিচালকের দায়িত্ব ছবি বানানোতেই শেষ হয় না। দর্শককে তার আসনে বসানো অবধি তার যে কাজ চলে। তিনি মানুষের ভাবনাকে গভীরে গিয়ে বুঝতেন , তা বারবার প্রকাশ পায় তার ছবি বানানোর ভঙ্গিতে। শুধু পরিচালক নয়, শিশু সাহিত্যিক সত্যজিৎকে নিয়ে  নতুন করে ভূমিকার প্রয়োজন নেই। ফেলুদা, তারীণী খুড়ো, প্রোফেসর শঙ্কুর স্রষ্টা তিনি। লিখেছেন বহু ছোট গল্প। সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদনা, সঙ্গীত পরিচালনা, চিত্রকার সত্যজিৎ একঅঙ্গে এত প্রতিভার বাস আমাদের বিস্মিত করে। তিনি আমাদের প্রাণের কাছের একজন মানুষ।

জন্ম ও ছেলেবেলা:

১৯২১ সালের ২ রা মে কথাশিল্পী সুকুমার রায়ের পুত্র সত্যজিৎ রায়ের  জন্ম হয়। মাতার নাম সুপ্রভা দেবী।সেই সময় বাংলা তথা ভারত বৃটিশ শাসনের অধীন।  আর তাঁর পিতামহের নাম উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। তিনি অল্প বয়সে হারালেন তাঁর পিতা সুকুমার রায় কে। যার শোক ছোট্ট সত্যজিৎ  রায়কে করে ছিল দৃড় এবং বাস্তববাদী।
শিক্ষাজীবন:
প্রথমে বালিগঞ্জ গভর্মেন্ট হাইস্কুল, তারপর প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া করেন।  এরপর তিনি ভর্তি হন শান্তিনিকেতন এর কলাভবনে। নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে চলতে থাকলো চিত্রশিল্প, ক্যালিগ্রাফির ক্লাস। এমনও সময় ছিল,যখন হস্টেলের মাটিতেই চলত কালির কেরামতি। মাত্র দুবছরেই তিনি চিনা লিপিতে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। তিনি তাঁর শিক্ষক নন্দলাল বাবুকে বলেন তিনি শিল্পের বানিজ্যিক দিকের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন। তাই তিনি ছাড়তে চান শান্তিনিকেতন
এবিষয়ে বাধা দেননি । তাই ফিরে আসা কলকাতাতে, ছিল অর্থাভাব।সেই অর্থাভাব কাটাতে পারছিলেন না তার মা  সুপ্রভা দেবী। তাই ফিরে এসে ১৯৪৩ সালে যোগ দিলেন জে.কে কিমার নামের অ্যাড এজেন্সিতে ,আশি টাকা মাস মাইনের চাকরী।  তার চার বছর পর ভারত স্বাধীন হল। আরো দুবছর পর এলো প্রজাতন্ত্র। কিন্তু ততদিনে বিজ্ঞাপন জগতের বড় নাম সত্যজিৎ রায় । ১৯৪৭এ প্রতিষ্ঠা করলেন “ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি”।

কর্মজীবন

১৯৪৯ সালে তিনি বিবাহ করেন বিজয়া রায়কে। তিনি শুধু সত্যজিৎ পত্নী নন। তিনি ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু এবং তার সবচেয়ে বড় ক্রিটীক। সত্যজিতের বহু গল্পের প্রুফ রিডার বিজয়া রায়।সে বছরেই কলকাতাতে আসলেন জাঁ রেনোর সত্যজিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলেন তিনি ছবি বানানোর প্রতি আকৃষ্ট হন। দেখলেন “ বাইসাইকেল থিভস”। শুরু করলেন ফিল্ম বানানোর পরিকল্পনা। আনুমানিক দশ হাজার টাকাতে কিনলেন পথের পাঁচালির সত্ত্ব ।  নিজের জমানো টাকাতে ছবি শুরু করলেও বিধানচন্দ্র রায় তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সহায়তায় তিনি শেষ পর্যন্ত ছবি শেষ করেন। আপনার ছেলেকে কেউ চেনে না।কিন্তু বিশ্বাস করুন , চার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমে ছবি শেষ হল। সমালোচকরা এরকম ছবি দেখে চমকে উঠলেন। বদলে গেল ভারতীয় সিনেমার ভাষা। অপরাজিত এনে দিল সত্যজিতকে গোল্ডেন লায়ন পুরষ্কার। হাততালি কুড়োলো। তারপর এক এক করে দর্শক দেখল “জলসাঘর”, “পরশপাথর”।

সিনেমায় সত্যজিৎ


তাঁর ‘অপুর সংসার ‘মানুষকে বুঝিয়ে দিল ভালোবাসার অন্য নাম। শর্মিলা ঠাকুর কে চিনল গোটা দুনিয়া। রোম্যান্টিসিসমকে যত উচ্চতাতে নিয়ে যাওয়াটার তার সাধারণত্বই তাকে করে তোলে অসাধারণ। দেবী, কাপুরুষ মহাপুরুষ, মহানগর, প্রতিদন্দ্বী, অভিযান , অরণ্যের দিনরাত্রি, জনরণ্য ইত্যাদি সিনেমা উল্লেখযোগ্য।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন তাঁর মানস পুত্র।উত্তম কুমার সে সময় মধ্য গগনে। তবু সত্যজিতের ছবিতে তিনি ছিলেন না। কিন্তু এলেন “নায়ক” ছবির হাত ধরে। অভিনয়ের ধারা বদলালেন  ক্যামেরা ,চিত্রনাট্যে এলো ডার্ক শেড। এছাড়া সেই ছবিতে বদলালেন গল্পের ধারা।

ছোটোদের সত্যজিৎ 


শিশু সাহিত্যের পরিবেশে যিনি বেড়ে উঠেছেন তিনি যে একজন বিরাট সাহিত্যিক হবেন তা বলার কথা নয়। কিন্তু সোনার কেল্লা তে প্রকাশ পেল বাংলা সাহিত্যের একজন গোয়েন্দা ,নাম প্রদোষ চন্দ্র মিত্র। ফেলুদার গপ্পো আজও আমাদের মনে গাঁথা আছে । তাঁর মগজাস্ত্রে ভর করে কেস  সলভের কেরামতি অবাক করলো। তাছাড়া ছিলেন তোপসে, আর লালমোহন বাবু। বন্ধুত্বের অনন্য নজির গড়লেন তাঁরা । সন্দেশ পত্রিকা তাঁর হাত ধরে দেখল নতুন জন্ম। এক এক করে জন্ম নিলেন তারিণী খুঁড়ো , প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু। যে পরিবারএর নান্দনিকতা জন্ম দেয় গুপী বাঘা সেই পরিবারে সাহিত্য চর্চা বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
একের পর এক ছোট গল্প বাতিকবাবু, বঙ্কুবাবুর বন্ধু, পটল বাবু ফিল্ম স্টার এর মতো লেখার মধ্যে নান্দনিকতাবাদের যে ছোঁয়া ছিলই শিল্পের দায়ে যে সমাজ বাদ যায় না তা বারবার বুঝিয়ে এসছেন। হীরক রাজার দেশে আজও প্রাসঙ্গিক যেরকম প্রাসঙ্গিক গুপী বাঘা, আমাদেরকে স্বপ্নিল আনন্দের পরিসর দেয়।

সঙ্গীতকার ও চিত্রকার সত্যজিৎ  

একজীবনে এতটা উচ্চতাতে নিজেকে নিয়ে যাওয়া যায় তা ওনাকে দেখে বোঝা যায়। এবার আসা যাক সঙ্গীতকার সত্যজিৎ এর কথায়। তার চর্চাতে বহুদিন ছিল পাশ্চাত্য সঙ্গীত। নিজের ছবির গান নিজেই সুর দিতেন, পথের পাঁচালীতে তাঁর হাত ধরেছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর। মোৎজার্ট সিম্ফনিকে উলটো করে বাজিয়ে তিনি বহু কাজ করেছেন। পরীক্ষামূলক কাজ তাঁর হাত ধরে অন্য মাত্রা পায়।যার কারণে তিনি এত চর্চিত।

পুরষ্কারের ঝুলি 

তিনি মোট ৩২ টি জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন। এছাড়া পেয়েছেন ভারতরত্ন, পদ্মভূষণের মতো পুরষ্কার। তাঁর মুকুটে পালকের নাম অস্কার পুরষ্কার। তাঁর শেষ জীবনের ছবি গুলি ছিল খানিক সমাজের প্রথাগত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আগন্তুক, শাখা প্রশাখা ছবি গুলি উল্লেখ করার মতো।তিনি চিত্রশিল্পী হিসাবে নিজেকে না পরিচয় না দিলেও তিনি সিগনেট প্রেসের হয়ে প্রচ্ছদ একেছেন। তাঁর ছবির পোস্টারগুলো তিনিই করতেন। । এছাড়া সন্দেশ এর আঁকা গুলো তাঁর কাজের অন্য মাত্রার প্রকাশ পায়।তাঁর রবিন্দ্রনাথকে দেওয়া শ্রদ্ধাঞ্জলি গুলি উল্লেখ্য।

মৃত্যু

বয়স বাড়ে, মানুষ থাকে না চিরকাল। সত্যজিৎ ও ছিলেন না , কিন্তু তাঁর কাজ আজও জ্যান্ত। তাঁর কথা, তাঁর ছবির ভাষা তাকে লেজেন্ড করে।২৩এপ্রিল , ১৯৯২ তিনি চলে গেলেন।

উপসংহার


আজ যে ছেলেটি ক্যামেরা হাতে ছবি তুলছে, বা যে ছেলেটা গরমের ছুটিতে ফেলুদা পড়ছে বা সেই মাঝ বয়সী লোকটা জয় বাবা ফেলুনাথ দেখছেন। যারা সত্যজিতে আছেন। তারা সবাই বলছেন, “ মহারাজা তোমারে সেলাম”, “জয় বাবা মানিকনাথ”
সত্যজিৎ রায় বেঁচে থাকবেন।কারণ তিনি ছবির ফ্রেমগুলোতে প্রাণ দিতে পারতেন।

সত্যজিৎ রায় অনুচ্ছেদ 

বাংলার মনীষা জগতে হাজার তারার ভিড়ে আরেকটি উজ্জ্বল তারার নাম  সত্যজিৎ রায়। ১৯২১ সালের ২রা মে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর পিতা সুকুমার রায়, মাতা সুপ্রভা দেবী, পিতামহ অমর কথাসাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। পারিবারিক দিক থেকে ঐতিহ্যশালী হলেও তিনি তাঁর স্বতন্ত্র পরিচিতি তৈরী করেছিলেন তাঁর নিজের গুণে। অল্প বয়েসে পিতাকে হারান। মাতা সুপ্রভা দেবী তাকে লালন পালন করেন লড়াকু কায়দায়। প্রথমে বালিগঞ্জ গভমেন্ট, তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজ এ পড়া শেষ করে,শান্তিনিকেতনে কলাভবনে পড়াশোনা করেন। তাঁর শিক্ষক ছিলেন শিল্পী নন্দলাল বসু। তাঁর কাছে তিনি কাজ শেখেন। অল্প দিনেই পারদর্শী হয়ে পড়েন ক্যালিগ্রাফিতে।তবে সেখানে পড়া শেষ না করে চলে আসেন কলকাতাতে, চাকরী নেন বিলিতি বিজ্ঞাপনী সংস্থাতে। ১৯৪৯ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বিজয়া দেবীর সাথে।
জা রেনোর শহরে এলে তাঁর সাথে আলাপ জমে, তাঁর ডাকে তিনি চললেন লন্ডন। সেখানে ছবি দেখে তিনি গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে পড়েন বিদেশী ছবির। দেশে ফিরে তিনি ঠিক করেন ছবি করবেন। জমানো টাকাতে হচ্ছিল না হাত বাড়ালেন বিধানচন্দ্র রায়। তাঁর সাহয্যে ছবি মুক্তি পায়, হাততালি কুড়োয় সমালোচকদের। ছবির নাম পথের পাঁচালী। তারপর আসে তাঁর ছবি অপরাজিত, তাঁকে এনে দিল গোল্ডেন লায়ন। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। একেরপরএক ছবির কাজ চলতে থাকে। তার মধ্যে দেবী, প্রতিদন্দ্বী, অপুর সংসার,অরণ্যের দিনরাত্রি, অভিযান, জনঅরণ্য, কাঞ্চনজঙ্ঘা উল্লেখ্য। তাঁর উত্তম কুমারকে নিয়ে করা নায়ক খুব বিখ্যাত হয়। শিশু মনকে নিয়ে ভাবতেন সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদক। তাঁর সৃষ্টি ফেলুদা , প্রোফেসর শঙ্কু, তারিণীখুড়ো আজও অমর। তাঁর বানানো সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে আট থেকে আশি সব্বার প্রিয়। তাঁর সৃষ্টি  লালমোহনবাবু তোপসের গপ্পোরা আমাদের আজও নিয়ে যায় আমাদের কৈশোরে।তিনি শহরের ভিড়ে মানুষের মনন নিয়ে ভাবতেন। মহানগর তাঁর কথাই বলে। এছাড়া পোস্ট মাস্টার, চারুলতা, ঘরে বাইরে সম্পর্ক নিয়ে কথা বলে। তাঁর সঙ্গীত সুর আজও রঙিন। তিনি যে প্রচ্ছদ এঁকে গেছেন তাঁর মধ্যেকার ভাবনার যে প্রকাশ তা আমাদের মুগ্ধ করে। তাঁর চিড়িয়াখানা, শাখাপ্রশাখা, আগন্তুক, শতরঞ্জ কা খিলাড়ি(হিন্দী) , জলসাঘর, পরশপাথর, অশনি সঙ্কেত আজও অমর। তাঁর ছোট গল্প , রহস্য গল্প আজও পড়তে মনটা চায়। তবে সৃষ্টি চিরকালীন হলেও স্রষ্টা চিরকালীন হতে পারেন না সবার চোখের তলা ভারী করে ২৩শে এপ্রিল ১৯৯২,তিনি চলে গেলেন।তিনি ৩২ টি জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন, পেয়েছেন দেশ বিদেশে অসংখ্য পুরষ্কার। তার মধ্যে অন্যতম হল অস্কার। এছাড়াও ভারত সরকার প্রদত্ত পদ্মভূষণ, ভারতরত্ন পান তিনি। আজও সবার মন, মস্তিষ্কে তাঁর অবাধ আনাগোনা। ভূতের রাজা মানিকনাথকে সারা পৃথিবী আজও বলে, মহারাজা তোমারে সেলাম।  

লেখক – রাহুল পাঠক